যখন পৌঁছলাম তখন ভরদুপুর। দোতলা রেস্টুরেন্টটিতে বেশ ভিড়।
মেনু ঘেঁটে দেখলাম- এখানে চিকেন, মাটন, হায়দ্রাবাদি, লখনৌ, মাটন-স্পেশালসহ বিভিন্ন ধরনের বিরিয়ানি ছাড়াও রয়েছে ভেজিটেবল বিরিয়ানি। যারা কোনো ধরনের মাছ, মাংস বা ডিম খান না তাদের জন্যই মূলত এই ব্যবস্থা।
আমাদের ছয়জনের দলটি সিদ্ধান্ত নিলো, একেকজন একেক ধরনের বিরিয়ানি অর্ডার দেবে, যেনো এখানকার কোন বিরিয়ানির স্বাদ কেমন তা বোঝা যায়। সে অনুযায়ী আমরা মাটন, হায়দ্রাবাদী, লখনৌ ও স্পেশাল বিরিয়ানি অর্ডার করলাম। অর্ডার করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছয়টি প্লেটে বিরিয়ানি হাজির। একেকটি প্লেটে বিরিয়ানির পরিমাণ দেখে আমরা তো থ, যেনো বিরিয়ানির ঢিবি! পুরো প্লেট শেষ করা একজনের পক্ষে কঠিন। অগত্যা ফিরিয়ে দিতে হলো এক প্লেট।
অর্ডার দেওয়া সব ধরনের বিরিয়ানিই ছিলো বেশ মজার। বাসমতি চালে রান্না করা সবগুলো বিরিয়ানিতেই তেল-মসলার ব্যবহার ছিলো পরিমিত। তবে তুলনামূলক হালকা মসলায় রান্না মাটন বিরিয়ানি পছন্দ করলেন স্বাস্থ্য সচেতন কয়েকজন। হায়দ্রাবাদি ও মাটন-স্পেশাল বিরিয়ানিতে বিভিন্ন ধরনের বাদাম, খেজুর আর কিসমিস দিতে কোনো কার্পণ্য করেননি রাঁধুনী। এখানকার বিরিয়ানি চাখার পর রেস্টুরেন্টে এতো ভিড়ের কারণ বোঝা গেলো।
কলকাতায় বিরিয়ানির জন্য প্রসিদ্ধ অন্য দুই রেস্টুরেন্ট হলো, নিজামস ও আমিনিয়া। এর মধ্যে নিউমার্কেট এলাকার নিজামসের নার্গিস বিরিয়ানিও বেশ সুস্বাদু। তবে স্বাদের দিক থেকে আরসালানের বিরিয়ানিই এগিয়ে মনে হলো। দাম ১৪০ রুপি থেকে ২৮০ রুপি পর্যন্ত। এ যাত্রায় আমিনিয়ায় খাওয়া হলো না।
এলাকা ও দেশভেদে খাদ্যাভ্যাস আলাদা। তবে কলকাতার সঙ্গে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে খুব একটা পার্থক্য নেই। সচরাচর আমাদের দেশের সবখানে মেলে না এমন কিছু খাবারের মধ্যে ইডলি, ধোসা অন্যতম। এগুলো অবশ্য বাঙালি খাবার নয়, সাউথ ইন্ডিয়ান।
সকালে রাস্তার পাশের দোকানে পুরি, লুচির পাশাপাশি বিক্রি হয় ইডলি-সাম্বার, ধোসা। ইডলি দেখতে আমাদের দেশের ভাঁপা পিঠার মতো। চালের গুঁড়ো দিয়ে বানানো সাদা নরম এই খাবারটি খেতে হয় সাম্বার দিয়ে। বাংলাদেশিদের কাছে এটি খুব বেশি সুস্বাদু না লাগলেও পুষ্টিকর।
কলকাতায় বাংলানিউজের অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক এ সফরে সবার থাকার ব্যবস্থা ছিলো রাজ্য যুব কেন্দ্রের ডরমেটরিতে (মৌলালি)। এর ঠিক উল্টো পাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান। মাত্র ১৫-২০ টাকায় লুচি আর আলুর দম দিয়ে সকালের নাশতা সারা যায়। শেষে মিষ্টিও মিলবে। শুকনো পাতার তৈরি ছোট ছোট বাটিতে পরিবেশন করা খাবারের দোকানগুলো আহামরি সাজানো-গোছানো না হলেও খাবার বেশ মজার।
পাশেই এক দোকানিকে দেখলাম, বিশাল একটি পরোটা ছিঁড়েছিঁড়ে নিক্তিতে মাপছেন। ১০ টাকায় একশো গ্রাম পরোটা আর পাঁচ টাকার বুটের ডাল, সঙ্গে বেশ বড় পেয়াজের টুকরো প্লেটে সাজিয়ে দুই পুলিশকে দিলেন।
পরোটা ছেঁড়ার কারণ জানতে চাইলে দোকানি বলার আগে দুই পুলিশের একজন বলে উঠলেন- বিশাল বিশাল পরোটা, একটি একজনের পক্ষে খাওয়া মুশকিল। খেয়ে নিন, আপনাদের ঢাকায় এমন পরোটা পাবেন না।
তার কথায় নেওয়া হলো একপ্লেট। খেতে বেশ ভালোই। তবে নিউমার্কেট এলাকার আশপাশের দোকাগুলোতে বড় লুচি বা পুরির সঙ্গে চানাবুট, ডাল বা সবজি খেতেও দারুণ। এখানে দাম ৪০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে। যা অন্যান্য এলাকার তুলনায় একটু বেশি মনে হয়েছে।
কলকাতার হাওড়া ব্রিজের উপর বিভিন্ন ধরনের পণ্যের পসার সাজিয়ে বসেন অসংখ্য নারী-পুরুষ। সেখানে মাত্র ৩০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে ক্যাপসিকাম। গাজর ছিলো সরু আর লম্বা ধরনের। মার্চের শেষ দিকে কলকাতার নিউমার্কেট এলাকায় যখন পাকা আম বিক্রি হচ্ছে তখন আমাদের দেশের আম ডালে দেওয়ার মতো বড় হয়েছে।
ফলের দোকানগুলোতে আস্ত আলু বোখারা দেখলাম। খয়েরি রঙের ফলটি আস্ত অবস্থায় আগে কখনও দেখিনি। কলকাতার ফলের দোকানগুলোতে বিক্রি হতে দেখলাম ‘টমাটিলো’ নামে বুনো এক ধরনের টমেটো জাতীয় ফল। আমাদের এখানে বনে-জঙ্গলে খোসায় মোড়া টমেটোর মতো ফলটি দেখেছি ছোটবেলায়। তবে এটি এখনও আমাদের কাছে বাণিজ্যিক রূপ পায়নি।
মার্কুইস স্ট্রিট, গালিব স্ট্রিট ও ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে আবদুল খালেক হোটেল, প্রিন্স, রাঁধুনী, কস্তুরী, ধানসিঁড়িসহ বেশ কয়েকটি মাঝারি মানের খাবারের হোটেল রয়েছে। মুসলিমরা মাংস জবাই ইসলামী কায়দায় হয়েছে কিনা জেনে নিতে পারেন ওয়েটারের কাছ থেকে। তবে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বেশিরভাগ পর্যটক এই এলাকায় বেশি থাকেন বলে এমন প্রশ্নে অভ্যস্ত সেখানকার হোটেল কর্তৃপক্ষ।
এ হোটেলগুলোর মধ্যে কস্তুরীর খাবার বেশ মজার, এরপরেই রাঁধুনীর অবস্থান। আবদুল খালেকের খাবারও সুস্বাদু তবে সেখানে বসার জায়গা পাওয়া কঠিন। কস্তুরী হোটেলের আলুপোস্ত, চিংড়ি আর পোস্ত দিয়ে কঁচুশাক, সরষে দিয়ে ভেটকি এবং ভাপা ভেটকির স্বাদের তুলনা হয় না। কিছু দোকানে ভাতের সঙ্গে পাপড় পরিবেশনও আমাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা।
কলকাতার অন্যতম আকর্ষণ মাটির ছোট ভাড়ে চা পরিবেশন। চলার পথে আনাচে-কানাচে এমন চায়ের দোকানের অভাব নেই। পাঁচ রূপিতে ছোট্ট মাটির পাত্রে একবার চা পান না করলে আফসোস থেকে যাবে।
স্ট্রিট ফুডের জন্য ভারতের সুখ্যাতি রয়েছে। নিউমার্কেট এলাকায় রাস্তার পাশে ভ্রাম্যমাণ অসংখ্য দোকান, কোনোটিতে চিকেন বা ভেজিটেবল মোমো তো কোনোটিতে মিলবে পাওভাজি। বিক্রি হচ্ছে পানিপুরি, ঝালমুড়ি, চাওমিন, পাকোড়া ও ভুট্টাসহ নানা ধরনের মুখরোচক খাবার। যারা নিউমার্কেট ঘুরে ক্লান্ত, তাদের জন্য কিছুদূর পরপর বিক্রি হচ্ছে মোসম্বি (লেবুজাতীয় ফল) জুস। রাস্তার পাশে তরমুজ, বাঙ্গি, পাকা পেঁপে, বিট, পেয়ারাসহ বিভিন্ন ধরনের ফল কেটে ছোট ছোট পাত্রে বিক্রি হচ্ছে। দাম ১০ থেকে ৩০ রুপির মধ্যে।
এখানকার হগ মার্কেটের বিভিন্ন ধরনের মসলার জুড়ি মেলা ভার। এখানেই প্রথম সুযোগ হয়েছে শুকনো ডুমুর খাওয়ার।
শুনেছি, স্ট্রিট ফুডের জন্য কলকাতা বিখ্যাত। এই ট্যুরে তারই যথার্থতা খুঁজে পেলাম।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১৭
এসএনএস