ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২১ মে ২০২৪, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পর্ব-১

আগ্নেয়গিরি চূড়ার দ্বীপ টেনেরিফ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৮
আগ্নেয়গিরি চূড়ার দ্বীপ টেনেরিফ ছবি: বাংলানিউজ

লন্ডনের বিরক্তিকর কনকনে শীত আর কুয়াশাঢাকা আকাশ পেছনে ফেলে টেনেরিফ এয়ারপোর্টে নামলাম। এয়ারপোর্টে নামা মাত্র এ অঞ্চলের উষ্ণ রোদ আর ঝকঝকে আকাশ দেখে সারা রাতের প্লেন যাত্রার ক্লান্তি ভুলে যেতে হলো।

টেনেরিফ এক আশ্চর্য সুন্দর দ্বীপ। যে দিকে চোখ যায় শুধু সমুদ্র আর উঁচু উঁচু পাহাড়, উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তা, আর প্রচুর কলার বাগান।

এ যেন চিরবসন্তের দেশ। এখানে সারা বছর সূর্য একইভাবে আলো দেয়, আর আবহাওয়াও একইরকম আরামদায়ক। দ্বীপের মাটিতে পা রাখা মাত্র মন ভালো হয়ে যায়।

স্পেনের দক্ষিণ-পশ্চিমে, মূল ভূখণ্ড থেকে বেশ দূরে রয়েছে কতগুলো ছোট ছোট দ্বীপ। এগুলো আফ্রিকার কাছাকাছি হলেও স্পেনেরই অন্তর্ভুক্ত। এসব দ্বীপ সৃষ্টি হয়েছে আগ্নেয়গিরির উদগীরণের ফলে। আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত গরম লাভা ধীরে ধীরে শীতল হয়ে সমুদ্রের ওপর শক্ত মাটি গঠন করে। এভাবেই তৈরি হয়েছে দ্বীপগুলো।
 
একসঙ্গে দ্বীপগুলোকে বলে ‘ক্যানারি আইল্যান্ড’। এ নামের তাৎপর্য পরে বলছি। আগে বলি এক আগ্নেয়গিরির কথা।
 
ছবি: বাংলানিউজক্যানারি আইল্যান্ডের দ্বীপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দ্বীপ হলো ‘টেনেরিফ’। দ্বীপটির মাঝ বরাবর উঠে গেছে বিশাল এক পর্বত, নাম- ‘টেইডে’। উচ্চতা ৩ হাজার ৭১৮ মিটার (১২ হাজার ১৯৮ ফুট)। এটি পুরো স্পেনের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু পর্বত। আর এটা সামুদ্রিক দ্বীপে অবস্থিত পৃথিবীতে তৃতীয় বৃহত্তম আগ্নেয়গিরি, যা এখনও সক্রিয়। এতে সর্বশেষ উদগীরণ হয় ১৯০৯ সালে।

তাছাড়া, এখানে রয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ‘ক্যাবল কার’। এর সাহায্যে উঠে যাওয়া যায় ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১ হাজার ৬৬৩ ফুট ওপরে। তবে আমার টেনেরিফ ভ্রমণের সবচেয়ে বড় আকর্ষণটা হচ্ছে, ‘টেইডে’।

প্রথম দু’দিনের মধ্যে শহরের সব আকর্ষণ দেখে কাটানোর পর তৃতীয় দিন চললাম আগ্নেয়গিরি দেখতে। যথাসময়ে রিসোর্টে বাস চলে এলো। কয়েকটি জায়গা থেকে যাত্রী তুলে, বাস চললো শহর ছাড়িয়ে।

টেনেরিফের যে প্রান্তেই যাওয়া যাক না কেন সমুদ্র চোখে পড়বেই। দ্বীপ বলে কথা! দেখতে দেখতে শহর পার হয়ে গেলাম। একটু চোখ লেগে গিয়েছিলো। হঠাৎ মনে হলো যেন পেছন দিকে হেলে যাচ্ছি। চমকে তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে মুখ থেকে আপনি বেরিয়ে এলো, ‘আরিব্বাস্‌’!

হাইওয়ে দিয়ে বাস ছুটে যাচ্ছে (খাড়া পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে)। সেটা আক্ষরিক অর্থেই হাইওয়ে। অনেকটা উঁচুতে উঠে এসেছি আমরা। একপাশে খাঁড়া পাহাড় আর অন্য পাশে অনেক নিচে পিঁপড়ের মতো ছোট ছোট ঘরবাড়ি আর বিস্তীর্ণ সমুদ্র যেন আকাশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। আর তারও ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘ!

নিচে অসমতল ভূমি যা দেখা যাচ্ছে, সেগুলো আসলে ছোট ছোট পাহাড়। যে পাহাড়ের ওপর দিয়ে বাস চলেছে সেখানেও রয়েছে অনেক ঘরবাড়ি। এতো ওপরেও মানুষ থাকে! দেখে একটু অবাকই লাগলো। ট্যুর গাইড জানালেন, এ শহরের নাম ‘ভিলাফ্লোর’ এটি স্পেনের সবচেয়ে উঁচু শহর। ভাগ্যবান মনে হলো শহরের বাসিন্দাদের। কারণ, তাদের বাড়ির জানালা বা বারান্দা থেকে যে অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়, এতে হয়তো ছুটি কাটানোর জন্য অন্য কোথাও যেতে হয় না।

ছবি: বাংলানিউজএদিকে বাস ওপরে উঠছে তো উঠছেই! বেশ কিছুটা গিয়ে আর ঘরবাড়ি নেই, সেখানে শুধু লম্বা লম্বা পাইন গাছ, শুধু পাইনের জঙ্গল, কোনো জনপ্রাণী নেই।   ওপরে নীল আকাশ আর তার নিচে সবুজ পাইনের নির্জন বন দেখে কিছুক্ষণের জন্য আগ্নেয়গিরি দেখার উত্তেজনা ভুলে গেলাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো লোকালয় বর্জিত এ পাইন বনের মাটিতে শুয়ে আকাশ দেখি।  

আরও কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম পাহাড়ের যে অংশে পাইন বন ছিল তা অনেকটা নিচে চলে গেছে। এরও অনেকটা নিচে দেখা যাচ্ছে মেঘ। একটু আগেই এখানটায় আবছা সমুদ্র চোখে পড়ছিল। তার মানে কি আমরা মেঘেরও ওপরে চলে এসেছি!

রাস্তার দু’পাশে শক্ত লোহার রেলিং, রেলিংয়ের ওপারে পাইন গাছের সারি। একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করলাম, যেখানে পাইন গাছগুলো গজিয়েছে, সেখানে মাটি নেই বললেই চলে। পাইনগুলো যেন পাথর ফুঁড়ে গজিয়েছে (আগেই বলেছি পুরো দ্বীপটি আগ্নেয়গিরির লাভার ওপর সৃষ্টি)। অনেকগুলো পাইন গাছকে দেখলাম বড় বড় পাথরের চাইয়ের ওপরে দাঁড়িয়ে। এসব গাছের গোড়ায় মাটির কোনো চিহ্নই নেই, অদ্ভুত!  

গাইড বললেন, এগুলো ক্যানারি পাইন, শুধু ক্যানারি আইল্যান্ডেই জন্মায়। অনেক বছর আগে এ পাইন বনে  দাবানল লেগেছিল। অনেকগুলো গাছের শরীরে দাবানলের পুরনো কালো দাগ দেখলাম। বেচারা গাছগুলো এখনও আগুনে পোড়া দাগ শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে।

যত ওপরে বাস উঠতে লাগলো প্রকৃতি ততই অদ্ভুত রূপ প্রকাশ করতে লাগলো। দূরে পাহাড় সারির নিচে শুধু সাদা মেঘের চাদর। একসময় পাইন বন শেষ হয়ে এলো, দেখা যেতে লাগলো শুধুই রুক্ষ নুড়ি পাথর, আর পাথুরে রঙের অদ্ভুত ঘাসের ছোট ছোট ঝোপ।

এবড়োথেবড়ো পাহাড়ের রং মিশকালো আর আকাশের নীলের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে  আছে ‘মাউন্ট টেইডে’। পর্বতটির উদ্ধত চূড়াটি বহু দূরে দৃশ্যমান। এসময় গাইড জানালেন, আমরা ‘টেইডে ন্যাশনাল পার্কে’ প্রবেশ করেছি।
 
ছবি: বাংলানিউজটেইডে পার্বত্য অঞ্চলকে ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় ১৯৫৪ সালে। পুরো পার্কটি আসলে একটি ভল্কানিক ক্রেটার, যা আগ্নেয়গিরির উদগীরণের ফলে বেরিয়ে আসা লাভার স্রোতে সৃষ্ট ভূপ্রকৃতি। আর এগুলোর মাঝখানেই দাঁড়িয়ে আছে মাউন্ট টেইডে।  

এ পার্কটি ২০০৭ সালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ এক অদ্ভুত বৈচিত্র্যময় জায়গা, শুধু পাথর ছাড়া আর কিছুই নেই। সবুজের চিহ্ন মাত্র নেই, জলাশয় নেই, গাছপালা কিচ্ছু নেই, যেন একটা পাথুরে মরুভূমি। কিন্তু পাথরের যে কত বৈচিত্র্য থাকতে পারে তা এ জায়গাটি না দেখলে বোঝা যাবে না।

বিচিত্র পাথরদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাস। নামাবে টেইডে ন্যাশনাল পার্কের কেবল কার বেসক্যাম্পে। সেখান থেকে কেবল কারে চড়ে উঠবো আরও উঁচুতে। কেবল কারের গল্পটা বরং পরের পর্বেই শুরু হোক।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৭
এনএইচটি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।