ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

সুদর্শনদের গ্রাস করে দক্ষিণের রানি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৮
সুদর্শনদের গ্রাস করে দক্ষিণের রানি ভারত মহাসাগরের এ দৃশ্য আকৃষ্ট করবে যে কাউকে

যুগজাকার্তা, ইন্দোনেশিয়া থেকে ফিরে: জুলাইতে ঢাকা ছাড়ার আগে উজ্জ্বল সবুজ রংয়ের একটি প্রিন্টের শার্ট কিনেছিলাম। তখনই ভেবেছিলাম, সাগড় পাড়ে যাওয়ার সুযোগ পেলে এই শার্ট পড়বো, কিছুটা হাওয়াই স্টাইলের।

প্রামবানান মন্দির আর চান্ডি কালাসান মন্দির ঘুরে দুপুর গড়িয়ে যায়। দ্রুত হোটেল থেকে চেক আউট করে এখানকার বিখ্যাত খাবার গুডগার স্বাদ নিলাম।

এবার উদ্দেশ্য ভারত মহাসাগর দেখা। মনে মনে থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার সাগর পাড়ের মতো নীল পানি আর অল্প প্রস্থের সাগর তীরের কল্পনা করে নিলাম।
 
গাড়িতে চাবি ঘুরাতেই আমার দিকে তাকিয়ে হতাশার হাসি ছুড়লেন দামার। বললেন, ‘দুঃখিত এই সবুজ শার্ট গায়ে দিয়ে তুমি এই সাগর পাড়ে যেতে পারবে না। সুস্থভাবে তোমার বাংলাদেশে ফেরা নিশ্চিত করতে চাই আমি। ’
 
ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলাম, আবার কি হলো!
 
দামার যা বললেন, তাতে বাকরুদ্ধ হলাম। বললাম তুমি, এসব বিশ্বাস করো? বললেন, পুরো যুগজাকার্তার মানুষ বিশ্বাস করে। আর এটা সম্মান প্রদর্শনও বটে সমুদ্রের রানিকে। তাই খুলে ফেলতে হলো সবুজ শার্ট। কারণ সমুদ্রের রানি সবুজ শার্ট পড়া যুবকদের প্রেমে পড়েন এবং তাকে সাগরে টেনে নিয়ে যান।  

জাভানিজ পুরাণে নিয়াই লোরো কিদুল হচ্ছে সমুদ্রের দেবি। আর তিনিই দক্ষিণ সাগর বা ভারত মহাসাগরের রানি। জাভানিজ বিশ্বাস মতে তিনি মাতারাম এবং যুগজাকার্তার সুলতানদের আধ্যাত্মিক সঙ্গীও বটে।

সাগর পাড়ে বসে প্রেমিক যুগলপুরাণ, অঞ্চল, সময় ভেদে নিয়াই রোরোর অনেকগুলো নাম রয়েছে। যেমন- রাতু লাট সেলাতান, গুষ্টি কানজেং রাতু কিদুল বা কানজেং রাতু আয়ু কেনচোনো সারি। অনেক জাভানিজ বিশ্বাস করেন রানির নামের আগে নিয়াই, কানজেং বা গুষ্টির মতো সম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার অপরিহার্য।  

পুরনো জাভানিজ শব্দে লারা মানে সুন্দরী বা কুমারী কন্যা। তবে এক সময় লারা শব্দটি লোরোতে উচ্চারিত হওয়া শুরু হয়, যার মতে অসুস্থ বা হৃদয়ভাঙ্গা কন্যা।  

কল্পনায় নিয়াই লোরো কিদুল দেখতে কেমন? অবশ্যই মৎস্য কুমারীর মতো। যার উপরের অংশ এক সুন্দরী নারী এবং নিচের অংশ মাছের। পুরাণ মতে দেবী যার জীবন নিতে চান তাকে কেউ ফেরাতে পারেন না। দক্ষিণ জাভার উপকূলীয় গ্রামগুলোতে এই বিশ্বাস প্রচলতি রয়েছে যে, রাণী প্রায়শই জেলে এবং পর্যটকরা পানিতে নামলে জীবন নিয়ে যান। বিশেষত সুদর্শন পুরুষ হলেতো কথাই নেই।

জাভানিজ লোকগল্প এবং সাহিত্যে এক জনপ্রিয় স্থান দখল করে নিয়েছেন নিয়াই লোরো কিদুল। এছাড়াও একই দিনে কয়েকবার তার আধ্যাত্মিক দক্ষতার পরিবর্তনের গল্পও মানুষের মুখে মুখে। আর যুগজাকার্তার ১১তম হাবেংকুবুওনো সুলতান তার অভিজ্ঞতায় এই সমুদ্রের রানিকে নিয়ন্ত্রণের ঘটনাও লিখে গিয়েছেন। রানি অন্য সময় বৃদ্ধা থাকলেও পূর্ণিমায় এক সুন্দরী যুবতী নারী হিসেবে রুপ নেন।  

লোক কথায় বিশ্বাস করা হয়, ভারত মহাসাগরের ঝড় এবং রাক্ষুসে সব স্রোতকে মাঝ সাগরের নিজ বাসা থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন নিয়াই লোরো কিদুল। আবার সুরাকার্তা এবং যুগজাকার্তার সুলতানের আধ্যাত্মিক স্ত্রী হিসেবেও লোক কথায় স্থান নিয়েছেন তিনি।

রানির প্রভাব রয়েছে মেরারি আগ্নেয়গিরি থেকে শুরু করে ক্রাতন হয়ে দক্ষিণ সাগর পর্যন্ত। এর মাঝে সোলো আর যুগজাকার্তা সাম্রাজ্যও পড়েছে।

নিয়াই লোরো কিদুল হচ্ছে সমুদ্রের দেবিলোককথার অনেক জায়গাতেই উল্লেখ রয়েছে রানি সামুদ্রিক সবুজাভ রংয়ের বা এই রংয়ের কাপড় পড়তেন। ষোলশ শতকের জাভানিজ মাতারাম সাম্রাজ্য এবং পাজাজারানের সুন্দানিজ সাম্রাজ্যের লোকগাঁথাগুলোতেই বেশি পাওয়া যায় সমুদ্রের রানির কথা। যাই হোক, জাভানিজ এবং সুন্দানিজ নৃবিজ্ঞানে জাভার এই দক্ষিণ সাগরের রানিকে হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের আগের নারী দেবতার রুপ হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে।  

এই সাগর উত্তাল। এর আগে আন্দামানকে দেখা সাগরের যে রুপ সেটা আর এখানে থাকলো না। বদলে গেলো। আমি দামারকে বললাম, এতো দেখি বঙ্গোপসাগরের চাইতেও গর্জন বেশি। কেমন জানি একটু বিরক্ত হলো। উত্তরে বললেন, এটাতো সাগর না, মহাসাগর। আহম, ঢোক গিললাম আমি।

দামার বললেন, প্রতি এপ্রিলে যুগজাকার্তার মানুষ হেঁটে এখানে আসেন প্রার্থনা করতে। প্রচুর ফল এবং অন্যান্য উপহার উৎসর্গ করা হয় সাগরের রানির উদ্দেশ্যে।

বাংলাদেশের কক্সবাজারের মতোই এখানে ঘোড়া রয়েছে। পর্যটকরা ঘোড়ায় আরোহন করে ছবি তোলেন। এছাড়াও রয়েছে বিচ কার। ৪ চাকার এই গাড়িগুলোর চাকা মোটা। খেলনা গাড়ির মতো তবে স্টার্ট দিতে হয় মোটরসাইকেলের মতো কিক দিয়ে। দু’জন দু’টি গাড়ি নিয়ে আধঘণ্টা ঘুরলাম বালুর ওপর। তবে পানির খুব কাছে যেতে সাহস হলো না আমার।  

এই সমুদ্র পাড়কে মোটেও রোমান্টিক বলা যাবে না। বরং কেমন যেন ভয় কাজ করে। এই বুঝি সাগরের সব পানিকে সুনামি বানিয়ে লোরো কিদুল আঁছড়ে পড়বে এই লোকালয়ে। গ্রাস করে নিবে জনপদ।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৮
এমএন/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।