সোমবার (১২ মার্চ) এ বিমানবন্দরেই ঘটে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্লেন দুর্ঘটনা। অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে অনেকটা দলছুটের মতোই এখানে আগমন।
'কাঞ্চন ভাই' তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, এ খবর রিলায়েবল। তার কথার সূত্র ধরেই ফোন দিলাম নেপালে অবস্থানরত ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদকে। তিনি নিশ্চিত করার পর টেক্সিক্যাব নিয়ে ছুটলাম কাঠমাণ্ডু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ততক্ষণে রাত বারটা বেজে গেছে। কনকনে শীত।
হাসপাতালের করিডরে একটি অ্যাম্বুলেন্স দাঁড় করানো। পাশেই বসে আছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারির গাড়ির চালক। কি করে যেন বুঝতে পেরেই জিজ্ঞাসা করলেন-বাংলাদেশি? উত্তরে হ্যাঁ, বলায় কাছে বসালেন। তারপর নানা আলাপের সময় আইসিইউ থেকে নামানো হলো ইমরানা কবীর হাসিকে। ওই রাতেই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। কাজ শেষে আমাদের হোটেলে ফিরতে রাত ১টা পেরিয়ে গেলো। আশিক জানালেন, কাঞ্চন ভাই ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি টিচিং কলেজের মর্গে। বেশ কৌতুহল, কে এই কাঞ্চন ভাই?
রোববার (১৮ মার্চ) সকালেই পরিচয় করে দিলেন আশিক। কাঞ্চন ভাই তার বিশ্ববিদ্যালয় হলের রুমমেট ও বড় ভাই। পুরো নাম আশিক কাঞ্চন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী হয়ে নেপালে পদায়ন পেয়েছেন।
১২ মার্চ দুর্ঘটনার পরপরই তিনি ছুটে আসেন বিমারবন্দরে। তারপর থেকে বলতে গেলে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েই লেগেছিলেন উদ্ধার তৎপরতা থেকে পুরো প্রক্রিয়ায়। ১৩ মার্চ সকালে দুর্ঘটনা কবলিতদের স্বজনরা নেপালে আসেন। কিন্তু নিহতদের কাছে যেতে পারেন না সঙ্গত কারণেই। আহতদের কাছেও বেশিক্ষণ থাকতে দেননি চিকিৎসকরা। অন্যদিকে অচেনা দেশ। তার রীতিনীতি, খাদ্যাভাস সবকিছুই অজানা।
আশিক জানালেন কাঞ্চন ভাই, রীতিনীতিও রপ্ত করে নিয়েছেন দুই বছরের প্রবাস জীবনে। যার পুরোটাই কাজে দিয়েছে এই দুর্ভাগা মানুষদের। নেপালি ভাষায় তার দারুণ দক্ষতাই মূলত সব সহজ করে দিয়েছে।
কাঞ্চন ভাইও তার দক্ষতা আর মহানুভবতার পুরোটাই ঢেলে দিয়েছেন। ভোরে যখন স্বজনরা হাসপাতালে না পৌঁছাতেন, তখন তিনি হাজির। কোনো মরদেহ শনাক্ত হলো, তার স্বজনকে খুঁজে বের করা, গণমাধ্যমকে জানানো, খাবার দোকান চিনিয়ে দেওয়া ইত্যাদি হেন কোনো কাজ নেই যেখানে তার উপস্থিতি নেই। আর এমন করেই তিনি হয়ে ওঠেছেন নেপালে সব বাংলাদেশির আস্থাভাজন। তার মহানুভবতা আর দরদী মনোভাবের কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দূতাবাস কিংবা ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ সবার সঙ্গে নিতে দ্বিধা করতেন না। রোববার (১৮ মার্চ) দুপুরে খাবার সময় অনেক জোড়াজুড়ি করেও তাকে কিছু খাওয়ানো গেলো না। বললেন, ভালো লাগে না। আশিক বলছিলেন কাঞ্চন ভাই অনেক দৃঢ়চেতা মানুষ। কিন্তু নামাজের জানাজা শেষে যখন প্রতিটি কফিন ধরে ধরে দূতাবাসের সামনে কার্ভাডভ্যানে তুলছিলেন। তখন তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি। তা দেখে আশিকের চোখও যেনো জলে ভরার উপক্রম। কেউ তার আত্মীয় নন। কাউকে কখনো দেখেননিও। অথচ যেন রক্তের বাঁধনেই তিনি বাধা। সোমবার ২৩টি মরদেহ নিয়ে বিমানবাহিনীর কার্গো প্লেন আকাশে উড়াল দেওয়া পর্যন্ত ছিলেন ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে। বিদায় বেলায় স্বজনদের দেখা গেছে তাকে জড়িয়ে ধরে আবেগে আপ্লুত হতে। নেপালের বুকে যেন নিজেই গোটা বাংলাদেশ হয়ে ওঠেছেন কাঞ্চন ভাই।
বাংলানিউজকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘আমি আসলে এতো মহানুভব মানুষ নই। দেশের বাইরে থাকি বলেই হয়তো এতোটা করতে পেরেছি। এতোটা টান অনুভব করেছি।
এর আগে, সোমবার (১২ মার্চ) ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার ও পাইলটের মধ্যে বিভ্রান্তির কারণে ইউএস-বাংলার একটি ফ্লাইট ৬৭ যাত্রী ও চারজন কেবিন ক্রুসহ রানওয়ে থেকে ছিটক পড়ে বিধ্বস্ত হয়। এতে ২২ নেপালি, ২৬ বাংলাদেশি ও ১ চীনা নাগরিক নিহত হন। তিন বাংলাদেশি ছাড়া সব মরদেহ বুঝিয়ে দিয়েছেন নেপাল কর্তৃপক্ষ।
পিয়াস রায় ও আলিফুজ্জামানের মরদেহ শনাক্ত করতে ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। তাদের মরদেহ এখনো ত্রিভুবন ইউনির্ভাসিটি টিচিং হসপিটালে রয়েছে। এদের মধ্যে মোহাম্মদ নজরুল ইসলামকে শনাক্তের পর আগামী বুধবারের মধ্যে ঢাকা পাঠানোর কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১২ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১৮
এএটি