দূর-দূরান্ত থেকে এই ইতিহাস-ঐতিহ্য সন্ধানপিয়াসী, উৎসুক মানুষ আসছেন। রাজবাড়ি, মঠ আর মন্দির দর্শন করে ইতিহাস জেনে নিশ্চয়ই শিহরিত ও পুলকিত হচ্ছেন।
পিরোজপুরের ঐতিহ্য হয়ে ওঠা প্রায় চারশ’ বছরের প্রাচীন রায়েরকাঠি রাজবাড়ি নিয়ে এমনই ধারণা বদ্ধমূল ছিলো। নানা মাধ্যম এ সম্পর্কে জেনে বরাবরই আগ্রহী ছিলাম অনিন্দ্য সুন্দর এ রাজবাড়ি, বিশেষত এর মঠগুলো দেখে চোখ জুড়াবার।
কর্মসূত্রে পিরোজপুর থাকায় অবশেষে এলো সে সুযোগ। গত ৪ আগস্ট সহকর্মী বুলবুল আহমেদ ও স্থানীয় সাংবাদিক শফিকুল ইসলামের সঙ্গে দেখতে গেলাম দেশের অন্যতম প্রাচীন এ পুরাকীর্তি।
মঠ ও রাজবাড়ি সম্পর্কে যে মিথ ছিল তা সত্য মনে হয়েছে, পুলকিত হয়েছি মঠ আর ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাজবাড়ি দেখেও; তবে বেশ আশাহতও হলাম।
প্রায় ভগ্নদশার মঠগুলো, বিলুপ্তির শেষ সীমায় পৌঁছানো রাজবাড়ির ভবনগুলো দেখে হতাশা কেবল বাড়ল-ই বটে। যে স্থাপনাগুলো পিরোজপুরকে আরো অনন্য স্থান দিতে পারতো, অবহেলা-অযত্নে তা দিন দিন বিলুপ্ত হতে চলেছে। যারা দেখতে, ঘুরতে আসছেন; প্রায় সবাই ফিরছেন মনের ক্ষুধা অপূর্ণ রেখেই।
বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের অন্যতম পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক স্থাপনা পিরোজপুরের রায়েরকাঠি রাজবাড়ি ও মন্দির আর মঠগুলো। এসব স্থাপনা প্রায় সাড়ে ৩শ’ বছরেরও বেশি পুরাতন। পিরোজপুর জেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে পৌর এলাকার রায়েরকাঠিতে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এই রাজবাড়ি ও মঠ। মূল জেলা শহর থেকে কিছুটা বেড়িয়ে সিএ অফিস পার হয়ে সোজা রাস্তা ধরে জেলা পুলিশ লাইনস গেলে কিছুটা সামনে ডানপাশে ১৬৬৮ সালে নির্মিত কালী মন্দির ও ১১টি মঠ। এরও প্রায় কয়েকশ’ গজ সামনে রাস্তার বিপরীতে দৃষ্টিনন্দন ও অপূর্ব নির্মাণশৈলীর ধ্বংসপ্রাপ্ত কয়েকটি ভবন।
কালের পরিক্রমায় আর অযত্নে এসব স্থাপনা প্রায় ধ্বংসের পথে। কিন্তু বয়সে যতই পুরাতন বা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত যাই হোক; মঠ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে মুহূর্তকাল মাত্র সুউচ্চ মঠ; রাস্তার ওপারে রাজবাড়ির ভবনগুলো দেখে মুগ্ধ হলাম, নয়ন জুড়ালো। এই অনুপম পুরাকীর্তি দেখে পর্যটকমাত্র মুগ্ধ হতে বাধ্য। ক্ষণকাল এখানে দাঁড়ালে অবচেতনেই মানসপটে ভেসে উঠবে এ রাজবাড়ির একসময়ের শৌর্য-বীর্যের রূপ।
ইট-সুঁড়কি দিয়ে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়েছে রাজবাড়ির প্রাসাদ ও মঠগুলো। কালের বিবর্তনে প্রায় ধ্বংসের পথে মূল রাজবাড়ির অধিকাংশ ভবন। এখনও যে কটি ভবনের দেখা মেলে তাও পুরোপুরি ধ্বংসের পথে।
তবে কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সুউচ্চ মঠ। এরও কয়েকটির অবস্থা করুণ। একটি মঠ সংস্কার করা হলেও দুটি এরই মধ্যে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বাকিগুলোর গায়ে, ওপরে জমেছে শ্যাওলা।
জন্মেছে আগাছা ও বিরুৎ। মঠগুলোর গায়ের চুন-সুঁড়কির আস্তরণও খসে পড়েছে অনেক জায়গায়। তবে পাঁচটির মতো মঠের কক্ষ রয়েছে এখনও বাস উপযোগী। এরই একটি কক্ষ ব্যবহার করা হয় এখানে সন্ন্যাসব্রত নিয়ে অবস্থানকারী ও মঠগুলো দেখভাল করা ইসকনের একদল মানুষের অফিসকক্ষ হিসেবে।
মঠগুলো এখনো দাঁড়িয়ে থাকলেও সবগুলোরই অবস্থা শীর্ণ। রাজবংশের উত্তরসুরীরা এর দেখভাল না করায় ও সরকারি যথাযথ কোনো উদ্যোগ না থাকায় ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলছে এ অঞ্চলের বৃহৎ রাজত্বের সবর্শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু। ঘণ্টাখানেক এসব ঘুরে দেখার সময়েও পর্যটকের দেখা পেলাম হাতেগোণা।
জানা গেলো, মূলত প্রচারণা ও পর্যটন সুবিধা না থাকাতেই এ দৃষ্টিনন্দন মঠ-মন্দির আর রাজবাড়ি দেখতে তেমন লোকের আনাগোনা হয় না। তবে প্রায় প্রতিদিনিই স্বল্পসংখ্যক মানুষ আসেন এখানে। ঘুরে ফিরে দেখেন, মুগ্ধ হন সবাই।
আবার প্রায় সবারই আক্ষেপ সপ্তদশ শতাব্দীর এ মনোরম নির্মাণশৈলীর অমূল্য এ প্রত্নসম্পদের দুর্দশা দেখে-এমনটা জানালেন মঠগুলোতে বর্তমানে বসবাসকারী দলের সদস্য স্বপন নন্দ কুমার দাস।
তিনিই জানালেন, বর্তমানে নানা বয়েসী তাদের ১৫ জন সদস্য মঠে থাকছেন। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা বিভিন্ন মঠ-মন্দিরে এভাবে থাকেন। সন্ন্যাসব্রত নেওয়া চট্টগ্রামের এই যুবক জানালেন, প্রতিদিনিই কিছু মানুষ আসেন, ছবি তোলেন। এসব দেখে মুগ্ধ হন। কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণের উদ্যোগের অভাবে তারা আহতও হন।
পুরোহিতদের খাবার আয়োজনের জন্য দুটি বৃহৎকারের মঠের মাঝখানের জায়গাতে তাদের রান্নাঘর বানানো হয়েছে। পাশের মঠটি নতুন করে চুন-সুঁড়কি দিয়ে নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু রঙ আর নকশা দুইই জানান দিচ্ছে, আদির সাথে এই নতুনত্বের বেশ ফারাক।
এ প্রসঙ্গে স্বপন কুমার দাস বললেন, মূলত কম বরাদ্দের কারণেই এটা সংস্কার করা গেলেও আগের মতো করা যায়নি। একপাশে সারিবদ্ধ নয়টির মতো মঠ। তার উল্টোদিকে রয়েছে ধ্বংসপ্রাপ্ত আরেকটি মঠ। এই মঠের পাশেই রয়েছে মুঘল সাম্রাজের চতুর্থ সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে তৈরি কালীমন্দির।
এখানকারই একটি মঠে স্থাপন করা হয়েছে ২৫ মণ ওজনের বিশালাকার একটি শিবলিঙ্গ। কষ্টি পাথরের তৈরি এ মহামূল্যবান শিবলিঙ্গটি উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শিবলিঙ্গ বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। তবে পর্যটকদের জন্য তা উন্মুক্ত নয়।
অপূর্ব নির্মাণশৈলীর এ প্রাসাদ, মঠ ও মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ভাটিয়াল রাজা রুদ্র নারায়ণ রায়। ইতিহাস আর জনশ্রুতি দুই-ই বলছে রাজবাড়ির মোট ২০০ একর জমিতে সে সময় নির্মিত হয়েছিল ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২০০টি ভবন। তার কতগুলো ছিলো বৃহৎ আকারের অট্টালিকা। কিন্তু চরম অবহেলা ও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ না থাকায় সেসব ভবনের কিছুই বলতে গেলে অবশিষ্ট নেই। ধ্বংসের শেষসীমায় পৌঁছানো যে কয়েকটি ভবন অবশিষ্ট রয়েছে, তারও আয়ু আর কয়েক বছর বড় জোর এবং এগুলো সংরক্ষণেরও অনুপযোগী। অথচ মূল্যবান এসব পুরাকীর্তির নকশা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। শিহরিত করবে।
ঘুরে-ফিরে দেখলাম, যে কয়েকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন এখনও দৃষ্টিগোচর হয়, সেগুলোতে জন্মেছে ঘন জঙ্গল! কয়েকটি ছোট আকারের ভবনে এখনও বসবাস করছে রাজবংশের বর্তমান প্রজন্ম। তবে শ্যাওলা জমে ও ধসে যাওয়া ভবনের দেয়ালগুলো ভালো করে খেয়াল করতে দেখা গেলো, তাতে দারুণ কারুকাজের চিহ্ন।
রাজবাড়ির প্রধান ফটক, বসবাসের প্রাসাদ, কাচারি, অতিথি ও নাট্যশালা, জলসাঘর, অন্ধকূপ সবকিছুই প্রায় নিশ্চিহ্ন এখন।
পিরোজপুর জেলার ইতিহাস, জেলা তথ্য বাতায়ন ও জনশ্রুতি থেকে জানা যায়,সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে যুবরাজ সেলিম (পরবর্তীতে সম্রাট শাজাহান) তার বাবা সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাংলায় চলে আসেন।
এরপর তিনি তৎকালীন ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ নিয়ে একটি পরগণা সৃষ্টি করেন। নিজের নামে পরগণার নাম রাখেন সেলিমাবাদ। এরপর ১৬১৮ সালে সেলিমাবাদ পরগণার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পান তৎকালীন হুগলি জেলার দিগঙ্গার জমিদার রাঢ় দেশীয় সেন বংশোদ্ভব কিংকর ভূঁইয়ার ছেলে মদনমোহন। ১৬২৮ সালে মদনমোহন ছেলে শ্রীনাথের নামে সেলিমাবাদ পরগণার কিছু জমি নেন।
শ্রীনাথ ঝালকাঠির লুৎফাবাদ গ্রামে কাচারি স্থাপন করে সেখানে বসবাস করতেন। এরপর মোগল সম্রাট শ্রীনাথকে রাজা উপাধি দেন। ১৬৫৮ সালে রাজা শ্রীনাথ রায়ের ছেলে রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পিরোজপুরের অদূরে এসে বসবাস শুরু করেন।
একপর্যায়ে তিনি ওই বসতি এলাকার জঙ্গল কেটে ও পরিষ্কার করে রাজবাড়ি এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বন-জঙ্গল কেটে ও সাফসুতরো করে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বলেই এ রাজত্বের নামকরণ করা হয় রায়েরকাঠি। একসময়ের প্রবল প্রতাপশালী এ রাজাদের শক্তি কমে যায় রাজপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে জমিদারি প্রথা চালুর ফলে। সে সময় রাজা রুদ্র নারায়ণ রায়ের উত্তরসূরীরা পরিণত হন জমিদারে। এরপর থেকেই মূলত রায়েরকাঠি পরিচিতি জমিদারবাড়ি হিসেবে। অমরেন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন এ রাজবংশের শেষ জমিদার।
কিভাবে যাবেন
বলেশ্বর পাড়ের বরিশাল বিভাগের অন্যতম জেলা পিরোজপুর। এর উত্তরে গোপালগঞ্জ, দক্ষিণে বরিশাল ও বরগুনা, পূর্বে ঝালকাঠি এবং পশ্চিমে বাগেরহাট। রায়েরকাঠি পৌরশহরে অবস্থিত হওয়ায় ঢাকা বা দেশের অন্যান্য যেকোনো জায়গা থেকে পিরোজপুর শহরে আসতে হবে। পিরোজপুর শহর থেকেই রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলে করে জমিদারবাড়িতে যাওয়া যায়। রিকশা ভাড়া ৪০ টাকা, অটোরিকশায় জনপ্রতি ১৫-২০ টাকার মতো।
ঢাকা বা অন্যান্য জেলার সঙ্গে পিরোজপুরের বাস যোগাযোগ রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন পরিবহনের এসি ও নন-এসি বাস। ঢাকার গুলিস্তান থেকে দোলা, ইমাদ ও টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস এবং সায়েদাবাদ থেকে ছাড়ে আরা, বলেশ্বর, হামিম, ফাল্গুনী প্রভৃতি বাস। এছাড়া গাবতলী থেকে সেবা গ্রীন লাইন, গ্রামীণ পরিবহন, সাকুরা, হানিফ, গোল্ডেন লাইন পরিবহনসহ বিভিন্ন বাস পাওয়া যায়।
নদীপথে সদরঘাট থেকে লঞ্চে করেও আসা যাবে পিরোজপুরের হুলারহাট ঘাটে। লঞ্চে জনপ্রতি ডেকের ভাড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মতো। রয়েছে সিঙ্গেল ও ডাবল বেডের কেবিন। কেবিনের ভাড়া পড়বে সিঙ্গেল ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা এবং ডাবল ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে।
সদরঘাট থেকে পিরোজপুরের হুলারহাট বন্দরগামী লঞ্চের মধ্যে অন্যতম রাজদূত, অগ্রদূত, আঁচল, টিপু, ফারহান, হিমালয় প্রভৃতি লঞ্চ। হুলারহাট ঘাট থেকে অটোরিকশা করে পিরোজপুর শহর হয়ে রায়েকাঠি। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ২০ টাকার মতো। চাইলে রিজার্ভ অটোরিকশাও পাওয়া যাবে।
থাকা ও খাবার ব্যবস্থা পিরোজপুর থাকার জন্য রয়েছে সার্কিট হাউজ, ডাক বাংলো ও রেস্ট হাউস। এছাড়াও রয়েছে বেসরকারি হোটেল রিল্যাক্স, রজনী, ডালাস, বলাকা, অবকাশ ও হোটেল ছাড়ানীড় ও আল মদিনাসহ বিভিন্ন আবাসিক হোটেল। খাবারের জন্য শহরে রয়েছে হোটেল আপ্যায়ন, প্রিন্স, রোজ গার্ডেনসহ মাঝারি মানের একাধিক রেস্টুরেন্ট।
লেখক: কবি ও ব্যাংকার।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৮
এমএ/