ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮) ৮ পর্বের হাঁটার মাটির রাস্তা।

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ৮
জালালগঞ্জ (রংপুর)-পলাশবাড়ী (গাইবান্ধা)= ৩৭.৩২ কিমি

বিশাল এক বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে দারুণ এক ঘুমের পরে সকালের নাশতা খেয়ে পথে নামতেই মণির চাচার সঙ্গে কথা হচ্ছিল এটা-সেটা নিয়ে। উনি আমাকে খানিক এগিয়ে দিতে বেরিয়েছেন।

চারপাশে দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত দেখেই কথায় কথায় উঠে এলো ধানের কথা। ২০০৩ সালে চাচা যখন গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে গ্রামে পাকাপাকি চলে এলেন, তখন ধানের মণ ছিল তিনশ বিশ টাকা আর ধান কাটা শ্রমিকের মজুরি ছিল পঞ্চাশ টাকা। ৮ পর্বের হাঁটার রাস্তা। আর গতবছর উনি মণপ্রতি ধান বিক্রি করে পেয়েছেন পাঁচশ টাকা আর শ্রমিকের দিনপ্রতি মজুরি বাবদ গুনতে হয়েছে দিনে সাড়ে চারশ টাকা। পনের বছরে ধানের মূল্য দেড় গুণ বাড়লেও শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে নয়গুণ। এ নিয়ে আফসোস করতে করতেই মধ্যস্বত্বভোগীদের অভিসম্পাত দিলেন। গতকাল পীরগাছা থেকে জালালগঞ্জ পর্যন্ত ১২ কিমি পথ এগিয়ে রাখায় ওই পথটুকু অটোতে গিয়ে জালালগঞ্জ থেকেই শুরু করলাম চরণ যুগলের উপর ভরসা করে যাত্রা।

ঘাঘট নদীর উপর নির্মিত ব্রিজের ওপারেই জালালগঞ্জ বাজার। প্রথম পদক্ষেপ যখন দিয়েছি, ঘড়ির কাঁটা তখন আটটার ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। আজ প্রথম থেকেই গ্রামের ভেতর দিয়ে পথ। খুব একটা কোলাহল নেই। মাঝে মাঝে একটা-দুটো সাইকেল-ভ্যান টুংটাং শব্দে বেল বাজিয়ে দৃষ্টিসীমার দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। পথের দুই ধারে বাঁশঝাড় আর বাঁশঝাড়। লিচুবাগান মোড় ঘুরতেই পীরগাছা উপজেলা ছাড়িয়ে ঢুকে পড়লাম মিঠাপুকুর উপজেলায়।

রাস্তার ধার ঘেঁষা বেলতুলী বাজার, দেউলপাড়া হয়ে কাচারিপাড়া যেতে খুব বেশি সময় লাগলো না। এদিকে একটা জিনিস বেশ লক্ষণীয়। ক্ষেতে যে ফসলই ফলাক না কেন, ক্ষেতের আল বরাবর সবাই কলাগাছ লাগাবেই। বাম পাশে পায়ের গোড়ালি সমপরিমাণ জলের এক খালের পাড় ধরে চলতে চলতে একসময় পুটিমারী। খানিক সামনে যেতেই বৈরাতী হাট। ৮ পর্বের হাঁটার মাটির রাস্তা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বরযাত্রীকে বলা হয় বৈরাতী। সামনে এগোতেই এক বাড়ির বারান্দায় চোখ পড়লো। মা এক হাতে বেত আর অপর হাতে বই নিয়ে নয়-দশ বছর বয়সী এক ছেলের কাছে পড়া আদায় করছেন। পরের মোড়টা ঘুরতেই ওই একই বয়সী একদল শিশু খেলছে ফুটবল। এই দুনিয়াটা বৈপরীত্যে ভরপুর।

তীব্র সূর্যালোক আর কলাগাছের ছায়া মিলে দারুণ সব অবয়ব বানিয়ে রেখেছে পিচঢালা রাস্তায়। পথের ধারে দেখা মিললো টিনে নির্মিত মডার্ন বাজার নামক এক বাজারের। পিচঢালা রাস্তার এখানেই শেষ। এবার পথ মাটির রাস্তা ধরেই। সাহাপুর থেকে শুরু হলো পীরগঞ্জ উপজেলা।

জাহাঙ্গীরাবাদ থেকে ডানে মোড় নিতেই এক লোকের কঠিন জেরার মুখে পড়ে গেলাম। তার কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে বার দুয়েক রাস্তা ভুল করলাম। তবে ম্যাপে তীক্ষ্ণ নজর রাখায় বেশি ভুগতে হলো না। এই অঞ্চলে অনেকগুলো বাড়ির সামনেই সমৃদ্ধ বাড়ি সাইনবোর্ড ঝোলানো। বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলেই মিলছিল এই খেতাব।

কেশবপুর, জ্যোতিডাঙ্গা মোড় হয়ে আবার পেলাম মণ্ডলের বাজার। দিন তিনেক আগেই লালমনিরহাটে পেয়েছিলাম একই নামের বাজার। চাতালের মোড় থেকে বামে যেতেই আবার পিচের রাস্তা। আধ কিমি সামনেই খাদ্যগুদাম নামক জায়গা থেকে আবার ডানে মোড়। সঙ্গী আবারো মাটির রাস্তা। মাটির রাস্তায় হাঁটতে ভালো লাগলেও এই রাস্তায় একটা অসুবিধা অনুভূত হচ্ছিল। এই রাস্তার দু’পাশে নেই কোনো গাছ। দুপুরের কড়া রোদে এগোতে ভালোই বেগ পেতে হচ্ছিল। এক ভ্যান মাটির হাড়ি নিয়ে ভ্যানচালক চোখের আড়াল হতেই নারকেলের পাতার চশমা পরা এক পিচ্চি কাছে এলো। ছবি তুলতে অনীহা দেখিয়ে বাড়ির পথ ধরলো একটু পরেই। ৮ পর্বের হাঁটার পথ। চারদিক থেকে ধেয়ে আসা 'বাড়ি কোঠের' জবাব দিতে দিতে পথ চলছি। জবাবে চট্টগ্রাম বলাতে একজন মাথা নেড়ে বললো- ও আইচ্ছা কুড়িগ্রাম! এই মাটির এবড়োখেবড়ো রাস্তায় এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল বার ধরে এক লোকের অসাধারণ ভারসাম্য রক্ষা করা দেখতে দেখতেই মিঠিপুরের রাস্তায়। গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে একটা জিনিসের অভাব অনুভূত হচ্ছিল। সেটা হলো মাইলফলক। মাটির রাস্তা শেষ হওয়ার পর খানিক পিচঢালা পথ ধরে এগিয়েই পেয়ে গেলাম নয়া মাদারগঞ্জ। ওখান থেকে ডানের রাস্তা ধরেই বাকি পথ। কালসারাডারা বাজার ছাড়াতেই শুরু হলো সাদুল্লাপুর উপজেলা, একই সঙ্গে গাইবান্ধা জেলাও। ইসলামপুর পেরিয়ে পেলাম পল্টন মোড়। ধাপেরহাট পৌঁছে হাতের বামে ঘুরতেই পেয়ে গেলাম মহাসড়ক। মহাব্যস্ত ঢাকা-রংপুর হাইওয়ে৷

মহাসড়কের গা ঘেঁষেই বয়ে গেছে ছোট্ট একটা খাল। বৈকালিকবাজার থেকেই রাস্তা ঢুকে গেছে পলাশবাড়ী উপজেলায়। এই রাস্তায় ধান আর চাল থেকে চিড়া বানানোর মিল সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিতে আটকাচ্ছিল। একে একে বিটিসিমোড়, মহেশপুর পেরিয়ে পেলাম বাঁশকাটা নামক একটা জায়গা। ওখান থেকেই ফোন দিলাম সবুজ ভাইকে। তসলিম ভাইয়ের এই বন্ধুর বাসাতেই আমার আজকের থাকার আয়োজন। ব্র্যাক মোড় হয়ে থানার সামনে যেতেই ওনাকে আরেকবার ফোন দিয়ে পথের দিশা জানলাম। এন্ডোমন্ডো অফ করতেই দেখি ততক্ষণে হাঁটা হয়েছে ৩৭ কিমির বেশি।

ফ্রেশ হয়ে উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মরত হারুন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে বেরুলাম। কাছেই থাকেন ওনারা। ওনার বাসায় নিয়ে গিয়ে বাকি কলিগদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই নানান কৌতূহল মিটাচ্ছিলাম ওনাদের।
রাতে খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল সবুজ ভাইয়ের সঙ্গে। ওনার জীবনে না পাওয়ার বেদনাগুলো শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল অল্পে তুষ্ট থাকাটাই সুখে থাকার মূলমন্ত্র।

চলবে...

*** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)

***পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)

***পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)

***পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)

***পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)

***পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)

***পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)

বাংলাদেশ সময়: ১০০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।