সৌদি আরব থেকে ফিরে: নবীর শহর সৌদি আরবের মদিনা। মদিনা মুনাওয়ারার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ‘মসজিদে নববি’।
রাসুল (স.) এর পবিত্র রওজা সংযুক্ত এই মসজিদকে কেন্দ্র করেই ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিলো। হিজরতের পর রাসুল (স.) এর নিজ হাতে তৈরি এই মসজিদের সঙ্গে মিশে আছে সারা বিশ্বের মুসলমানের শ্রদ্ধা ও আবেগ।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে থাকা অনেকে ইচ্ছা সত্ত্বেও এই মসজিদ দেখার সুযোগ পান না। বিষয়টি মাথায় রেখে সৌদি সরকার ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের ওয়েবসাইটে ভার্চ্যুয়ালি মসজিদে নববি ঘুরে দেখার সুযোগ চালু করেছে। এজন্য ঢুঁ মারতে হবে https://vr.qurancomplex.gov.sa/msq/ এই ওয়েবসাইটে।
সম্প্রতি মসজিদে নববির স্থাপত্যের বিশ্বকোষ মোড়ক উন্মোচন করেছেন মদিনা অঞ্চলের গভর্নর প্রিন্স ফয়সাল বিন সালমান বিন আবদুল আজিজ। বিশ্বকোষে মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এর যুগ থেকে সৌদি যুগ পর্যন্ত মসজিদের স্থাপত্য বিবরণ ও অবকাঠামোর ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
মসজিদের মূল স্থাপনা ৬ লাখ ১৪ হাজার ৮০০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে অবস্থিত। আর মসজিদ ও আঙ্গিনা মিলে আয়তন ১০ লাখ ২০ হাজার ৫০০ বর্গমিটার। সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ ২০১২ সালে সংস্কারের পর মসজিদে নববী একসঙ্গে ১৮ লাখ মুসল্লির নামাজ আদায়ের জন্য প্রস্তুত হয়।
বাদশাহ আব্দুল্লাহর নির্দেশে মসজিদে বিশেষ কাঠামোতে তৈরি ২৫০টি ছাতা স্থাপন করা হয়। এসব ছাতা প্রায় এক লাখ ৩৪ হাজার বর্গমিটার এলাকায় ছায়া দিতে সক্ষম। দ্বি-স্তরবিশিষ্ট স্বয়ংক্রিয় এই ছাতাগুলো মুসল্লিদের বৃষ্টি ও সূর্যের তীব্র উত্তাপ থেকে সুরক্ষিত রাখে।
ইতিহাস বলছে, হিজরতের বছর ৬২২ সালে শুরু হয় মসজিদে নববির নির্মাণকাজ। ৬২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাত মাস সময় লেগেছে কাজ শেষ হতে। মদীনায় প্রবেশের পর রাসুল (স.) এর উটনি ‘কাসওয়া’ যে স্থানটিতে বসে পড়েছিল, সেই স্থানেই তৈরি করা হয় ঐতিহাসিক মসজিদে নববি।
মদিনার দুই এতিম বালক সাহল ও সোহাইলের কাছ থেকে ১০ দিনারের বিনিময়ে জায়গা কিনে নেওয়া হয়, যা হযরত আবু বকর (রা.) পরিশোধ করেন। জমির এক অংশে রাসুল (স.) এর জন্য বাসস্থান এবং বাকি অংশে তৈরি করা হয় মসজিদ।
আব্দুল্লাহ ইবন উমরের বর্ণনা অনুযায়ী, রাসুল (স.) এর যুগের মসজিদের ভিত্তি ছিল ইটের, ছাদ ছিলো খেজুরের ডালের এবং খুঁটি ছিলো খেজুর গাছের কাণ্ডের। সেসময় মসজিদের পরিধি ছিল ২৫০০ মিটার। ৭ম হিজরিতে মসজিদে নববির প্রথম সম্প্রসারণ রাসুল (স.) নিজেই করেন। তখন আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৭৫ স্কয়ার মিটারে।
এরপর ৬৩৮ সালে দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) মসজিদে নববির সংস্কারে হাত দেন। মসজিদের চারপাশে জমি কিনে এর আয়তন বৃদ্ধি করেন। তবে যেদিকে উম্মাহাতুল মুমিনিনদের ঘর ছিলো সেদিকটা অপরিবর্তিত রাখা হয়। ৬৫০ সালে তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.) খোদাইকৃত পাথর ও প্লাস্টারের দেয়াল তৈরি করেন এবং খোদাইকৃত পাথর ও লোহার ব্যবহারে পিলার ও স্তম্ভ স্থাপন করেন। ছাদ নির্মাণ করেন কাঠ দিয়ে।
৭০৭ সালে খলিফা উমাইয়া শাসক ওলিদ ইবনে আব্দুল মালিকের নির্দেশে মক্কার গভর্নর ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ মসজিদে নববির সম্প্রসারণ করেন। সেসময় মসজিদের পরিধি বৃদ্ধি হয় ৬ হাজার ৪৪০ বর্গমিটার। তিনি মসজিদে চারটি মিনারা ও একটি মেহরাব স্থাপন করেন।
তাছাড়া অভ্যন্তরীণ স্তম্ভগুলোকে মরমর পাথর ও সোনার কারুকার্জ দিয়ে সাজান। এসময় স্তম্ভের সংখ্যা ছিল ২৩২টি। তিনি হজরত আয়েশা (রা.) এর কক্ষটি মসজিদে নববির অন্তর্ভুক্ত করেন এবং তার ওপর সবুজ গম্বুজ স্থাপন করেন।
আব্বাসী খলিফা আল মাহদি ১৬১ থেকে ১৬৫ হিজরিতে মসজিদের আয়তন ৮ হাজার ৮৯০ বর্গমিটারে উন্নীত করেন। ৬০টি জানালা ও ২৪টি দরজা লাগান। মামলুক শাসনামলেও মসজিদে নববীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়। প্রধান চারটি ফটক ছাড়া অন্য দরজাগুলো পিতল দিয়ে নকশা ও সজ্জিত করা হয়।
উসমানি খলিফা সুলতান সুলেমান গম্বুজ মেরামত করেন এবং তার ওপর সোনায় মোড়ানো চাঁদ স্থাপন করেন। ১২৭৭ হিজরিতে ফাটল দেখা দিলে সুলতান আব্দুল মাজিদ মসজিদের সংস্কার করেন। তখন মসজিদের আয়তন বেড়ে ১০ হাজার ৩০৩ বর্গমিটার হয়। এসময় তিনি পাঁচটি নতুন দরজা সংযুক্ত করেন এবং ১১ মিটার পর্যন্ত প্রাচীরের উচ্চতা বৃদ্ধি করেন। তাছাড়া ১৭০টি গম্বুজ ও ৬০০টি তেলপ্রদীপ স্থাপন করেন।
১৯০৯ সালে এই মসজিদের মাধ্যমেই আরব উপ-দ্বীপের বিদ্যুতায়ন শুরু হয়। সৌদি যুগ শুরু হলে বাদশাহ আব্দুল আজিজ ১৯৫০ সালে মসজিদে নববীর পরিধি ১৬ হাজার ৩২৭ বর্গমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। এসময় মসজিদের স্তম্ভ ছিল ৭০৬টি ও গম্বুজ ছিল ১৭০টি। ১৯৭৩ সালে বাদশাহ ফয়সাল মসজিদের পশ্চিম দিকে প্রায় সাড়ে ৩৫ হাজার বর্গমিটার জায়গা বরাদ্দ দেন এবং সমগ্র এলাকাজুড়ে বৈদ্যুতিক পাখা, সাউন্ড সিস্টেম ও বিশেষ ছাতা স্থাপন করেন।
বাদশাহ খালিদ বিন আব্দুল আজিজের পর ১৪০৪ হিজরি থেকে বাদশাহ ফাহাদের ১০ বছরের সংস্কার ও সম্প্রসারণে তা রূপ পায়। মসজিদের আয়তন বৃদ্ধি পায় ৮২ হাজার মিটার। এসময় চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন করা হয়। সবশেষ সম্প্রসারণের কাজ করেন বাদশাহ আব্দুল্লাহ।
এই মসজিদ সম্পর্কে আল্লাহতাআলা বলেন, ‘অবশ্যই যে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকওয়ার ওপর প্রথম দিন থেকে তা বেশি হকদার যে, তুমি সেখানে সালাত কায়েম করতে দাঁড়াবে। সেখানে এমন লোক আছে, যারা উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করতে ভালবাসে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’। (সুরা তাওবা: ১০৮)
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার মসজিদুল হারামের পর পৃথিবীর অন্য সব মসজিদের চেয়ে তাঁর মসজিদে নামাজ আদায়ে এক হাজার গুণ বেশি সওয়াবের কথা উল্লেখ করেছেন। সারা বছর ওমরার জন্য এবং হজের মৌসুমে লাখ লাখ মুসল্লি মসজিদে নববিতে হাজির হন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৩
এসএস/টিসি