মৌলভীবাজার: প্রকৃতি চিরনির্ভয় এবং চিরসহচর। মানব এবং প্রাণিকূলে সে অভয়বার্তা ছড়িয়ে জানান দিয়েছে তার বিশালতা।
প্রকৃতিকূলের সৌন্দর্যবেষ্টিত বিস্ময় পাখি। বিচিত্র পাখির বর্ণিল সমারোহে সমৃদ্ধ আমাদের প্রকৃতি। প্রকৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং সুরক্ষা দান করতে উড্ডয়নশীল এই প্রাণীর রয়েছে অবিচ্ছেদ্য উপকারী ভূমিকা।
আমাদের দেশের বিচরণকারী পাখিকূলের একটি বিশেষ প্রজাতির নাম বাবুই (Black-breasted Weaver)। যারা অতি সুন্দর করে নিজের বাসা তৈরি করতে সক্ষম। এই কৃতজ্ঞতা আর সৌন্দর্যবোধ থেকেই বোধ হয় কবি রজনীকাণ্ড সেন বাবুই পাখির আজন্ম শ্রীকার্যসিদ্ধি’র জয়গান রচনা করেছেন ‘স্বাধীনতার সুখ’ নামক কালজয়ী কবিতাটি। ‘বাবুই পাখিকে ডাকি বলিছে চড়াই’ – লাইন উচ্চারণ করলেই আমাদের শৈশব-কৈশোর সামনে এসে বড় আশ্চর্যভাবে দাঁড়ায়!
বাবুই দারুণ সৌন্দর্যময়ী শিল্পীপাখি। শিল্প নিয়েই তার যত কাজ! নিজের বসতগৃহ নির্মাণে সে নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী হিসেবে সৃষ্টির সূচনাকাল থেকেই প্রমাণ দিয়ে আসছে। দৃষ্টিনন্দন নিজের বাসা তৈরিতে তার ধারে-কাছেও কোনো পাখি নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে বাবুই পাখির প্রজননসংকট। এ পাখির ছানাগুলোকে তালগাছের নিচে পড়ে মরে যাচ্ছে। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা নয়!
পাখির বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের নির্মিত সেই সুন্দর বাসাটি এতোটাই শক্তিশালী আর সুরক্ষিত যে কালবৈশাখী, টর্নেডো বা বড় কোনো ঝড় ব্যতিত তাল গাছ থেকে বাসাটি ছিঁড়ে যাওয়ার বা বাসার ভেতরে অবস্থানরত ছানাগুলো নিচে পড়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে ছানাগুলো পড়ে যাচ্ছে কী কারণে?
বাংলাদেশের প্রখ্যাত পাখি গবেষক এবং পাখি বিষয়ক বহুগ্রন্থের লেখক শরীফ খানের যোগাযোগ করা হলে এ ব্যাপারে তিনি বলেন, বাবুই পাখির বাসা থেকে তার ছানা পড়ে যাওয়ার ঘটনাটি সচরাচর ঘটে না। কারণ, বাবুইয়ের ওই বাসাটির যে কায়দায় তৈরি করা তার ভেতর থেকে সাধারণত পড়বে না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এমনিতে ছানাগুলো ওই বিশেষভাবে তৈরি করা বাসা থেকে পড়ার কোনো সম্ভাবনাই নাই। যদি না ছানাগুলো দুষ্টমি করে বাসার চেম্বার থেকে বাইরে না আসে। ছানাগুলো বাসার চেম্বার থেকে বের হলেই কিন্তু চুঙ্গা দিয়ে নিচে পড়ে মরে যাবে।
বাবুই ছানা মাটিতে পড়ার প্রথম কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, কোনো শিকারি পাখি অর্থাৎ যারা পাখির বাচ্চা খায় ওরা বাবুইয়ের বাসায় হানা দিয়ে থাকতে পারে। যেমন- সবচেয়ে ভয়ংকর একটা শিকারিপাখি হলো তুরমতি বাজ (Red-necked Falcon)। সে অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন এবং দুর্ধর্ষ। এই পাখিটির অতর্কিত আক্রমণে অনেক সময় পাখির ছানাগুলো মাটিতে পড়ে মরে যায়।
দ্বিতীয় কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এক প্রকারের লম্বালেজি-গেঁছো ইঁদুর (Indian Long-tailed Tree Mouse) আছে ওরা পাখির বাচ্চা-টাচ্চা খাওয়ার জন্য এক্কেবারে ওস্তাদ। সম্ভবত এই ইঁদুর বাবুই পাখির বাসায় উঠে ২/৩টা বাচ্চা খেয়েছে এবং অবশিষ্ট ২/১টা ভয় পেয়ে পাকা সড়কের ওপর পড়ে মরে গেছে।
তৃতীয় কারণকে ‘দূর সম্ভাবনা’ হিসেবে উল্লেখ করে শরীফ খান বলেন, বর্তমানে আমাদের প্রকৃতিতে প্রচণ্ড তাপদাহ চলছে। এই ভয়ানক গরমে মানুষের পাশাপাশি পশুপাখিরাও অতিষ্ঠ। পাখির ছানাদের মা-বাবা যখন খাবার নিয়ে আসে তখন সব ছানাগুলো গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ‘আগে খাবো’ ‘আগে খাবো’ বলে ঠ্যালাঠ্যালির সাথে ঠোঁট বাড়ায়। প্রকৃতিতে যত রকম পাখি আছে তাদের ছানারা মা-বাবার কাছ থেকে খাবার গ্রহণ করার জন্য ঠ্যালাঠ্যালি শুরু করে। তখন অসাবধানতাবশত ছানাগুলো নিচে পড়ে গিয়ে ছানাগুলো মারা যেতে পারে।
আমাদের প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন কারণে বাবুই পাখির বাসা কমে যাচ্ছে। এখন এগুলো খুব কম দেখা যায়। পথের পাশে তালগাছ এবং তালগাছের বাবুই পাখির বাসা এগুলোকে সংরক্ষণ করা দরকার বলে জানান বরেণ্য ওই পাখিবিদ শরীফ খান।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০২৩
বিবিবি/এএটি