ঢাকা, রবিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

৫০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করছে ‘ঘোড়াদহ মেলা’

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২৩
৫০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করছে ‘ঘোড়াদহ মেলা’ ঘোড়াদহ মেলার একাংশ।

রাজশাহী: রাজশাহীর দুর্গাপুরের রাইচাঁদ নদীর সেই ভরা যৌবন আর নেই। নাব্যতা সংকটে খরস্রোতা নদী এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে।

এক সময় রাইচাঁদ নদীতেই হতো নৌকা বাইচ। আর তীরে হতো ঘোড় দৌড়। সেই নৌকা বাইচ ও ঘোড় দৌড়কে কেন্দ্র করে পাশের মাঠেই বসতো বিশাল গ্রামীণ মেলা।

যেই কারণে এই মেলার নামকরণ হয়েছিল ‘ঘোড়াদহ মেলা’। আজ সেই নৌকা বাইচ নেই, নেই ঘোড় দৌড়ও। তবে সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এখনও বসছে গ্রামীণ ‘ঘোড়াদহ মেলা’। আর দুর্গাপুর উপজেলার উজান খলসী গ্রামের ঘোড়াদহ মেলার রয়েছে সুদীর্ঘ পাঁচশ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। অন্তত তিন পুরুষ থেকে এই ঘোড়াদহ মেলার ইতিকথা শুনে বড় হয়েছেন এই অঞ্চলে থাকা আজকের প্রৌঢ়রা। তার আগের ইতিহাস সবার স্মৃতিতে আজও আটকে আছে আবছায়ার মতো।

মেলায় ফটফটি খেলনা নিয়ে ঘুরছে এক শিশু।

রাজশাহী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে দুর্গাপুর উপজেলা। উপজেলা সদর থেকে আরও প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে কিসমত গণকৈড় ইউনিয়নের উজান খলসী গ্রাম। এই গ্রাম ও ভবানীপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া রাইচাঁদ নদীর পাড়েই বসেছে ঘোড়াদহ মেলা।

এই মেলাকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যেন এখন বিরাজ করছে ঈদের আনন্দ। ঘোড়াদহ মেলা যেন দুর্গাপুরবাসীর কাছে অন্যরকম এক আবেগ ও অনুভূতির। এই মেলাকে ঘিরে গ্রামের পথে পথে যেন এখন চলছে অনাবিল এক উৎসবের ঘনঘটা। সকাল-বিকেল হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় প্রকম্পিত হয়ে উঠছে মেলা প্রাঙ্গণ।

কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা না থাকলেও পার্শ্ববর্তী নওগাঁ, নাটোর, পাবনাসহ উত্তরের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ পণ্যের পসরা নিয়ে হাজির হয় এই ঘোড়াদহ মেলায়।

গরম তেলে জিলাপি ভাজছেন এক দোকানি।

কাঠের তৈরি করা বিভিন্ন ডিজাইনের আসবাবপত্র, খেলনা, মনোহারী, রংবেরঙের চুড়ি, কসমেটিকস, মুখরোচক খাবার কি নেই এই মেলায়? আছে সবই। তাই সকাল-বিকেল এই মেলা যেন লোকে লোকারণ্য হয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী শহর থেকেও এই গ্রামীণ মেলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দেখতে এবং জানতে ভিড় করছেন প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদ উজান খলসীতে।

কিসমত গণকৈড় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, তিন পুরুষ পর্যন্ত এই মেলার ইতিকথা জানা যায়। তবে এর কয়েক পুরুষ আগে থেকেই চলে আসছে ঘোড়াদহ মেলার প্রচলন। যত দূর জানা যায়, পাঁচশ বছরের ঐতিহ্য বহন করছে উজান খলসী গ্রামের এই ঘোড়াদহ মেলা। প্রতিবছর আশ্বিন মাসের শেষ দিন থেকে এই মেলা শুরু হয়। চলে ২ কার্তিক পর্যন্ত। কিন্তু এখন মেলার পরিধি বেড়েছে। তাই ব্যবসায়ীদের কারণে মূল মেলাটি আরও আট দিন ধরে চলে। মেলাকে কেন্দ্র করে উজান খলসী গ্রামে তাই আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ঘোড়াদহ মেলাকে ঘিরে উৎসব চলে আশপাশের ১০ গ্রামে। এ সময় মেয়ে ও জামাতাকে নিমন্ত্রণ করে দই দিয়ে মুড়ি-মুড়কি খাওয়ানো, অতিথি আপ্যায়ন এবং স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে আসার রেওয়াজ চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।

মেলায় ফটফটিসহ বাহারি খেলনা নিয়ে ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করছেন বিক্রেতারা।

ওই গ্রামের কৃষক জমির উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, তার বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগেও পাশের রাইচাঁদ নদীতে নৌকার প্রতিযোগিতা ও ঘোড়া দৌড় হতো। চলতো গান-বাজনাও। তবে কালের বিবর্তনে সেই ভরা যৌবনা নদী আর নেই, সেই উৎসবও নেই। তবে এখনও সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চলছে তাদের। সেসব না থাকলেও নিয়ম রক্ষার জন্য এই গ্রামীণ মেলার জমজমাট আয়োজনটা চালু রাখা হয়েছে। এই মেলার জন্য কোনো ঘোষণা বা মাইকিং লাগে না। ন্যূনতম কোনো প্রচারণা ছাড়াই প্রতিবছর আশ্বিনের শেষ দিনে মেলা বসে এখানে।

আচারে কিনছেন দুই নারী।
ঘোড়াদহ মেলায় গিয়ে দেখা গেছে, বাহারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। গরম তেলে ভাজা হচ্ছে জিলাপি। পরে সেই ভাজা জিলাপি ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে মিষ্টি রসে। রয়েছে গুড়ের জিলাপিসহ মজাদার মিষ্টান্ন। ভুট্টার খই, ধানের খই, গুড়ে মাখানো খই, বাতাসা, মজাদার খাগরাই, চিনির ঝুরি ভাজা, গুড়ের ঝুরি ভাজা, তিল, নারিকেল ও চালসহ বিভিন্ন ধরনের নাড়ু, ফুচকা, আচার, চটপটিসহ বিভিন্ন ভাজাপোড়া মুখরোচক খাবার।

ঘোড়াদহ মেলায় শিশু-কিশোরদের জন্য আছে, ঐতিহ্যের ফটফটি (টমটম), খেলনা, বাঁশি, গাড়ি, বেলুন, হাঁড়ি-পাতিল। কিশোরী ও নারীদের জন্য চুড়ি, ফিতা, আলতা থেকে সাজসজ্জার জন্য বিভিন্ন কসমেটিক পণ্য। আর গৃহস্থালির সব জিনিসপত্রই স্থান পেয়ে এই ঘোড়াদহ মেলায়।

মনোরঞ্জন ও বিনোদনের জন্য রয়েছে, নাগরদোলা এবং ময়ূরদোলনা। শিশু-কিশোররা মেলায় গিয়ে এগুলোতে চড়ে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে।

মেলায় দর্শনার্থীরা।

কথা হয়, মেলায় আসা শিশু ফারিয়ার সঙ্গে। সে জানালো দাদার ঘাড়ে চেপে মেলা দেখতে এসেছে। এসেই রসে ভেজানো গরম গরম জিলাপি খেয়েছে। তিলের নাড়ুও খেয়েছে। খেলার জন্য কিনেছে বেলুন এবং হাঁড়ি-পাতিলও। মেলার ঘুরতে এসে ভীষণ আনন্দ লাগছে তার।

ছয় বছরের শিশু নয়ন জানায়, মেলায় এসে একটি ফটফটি (টমটম) ও দুটি বেলুন বাঁশি কিনে দিয়েছেন তারা বাবা। আর বাড়িতে থাকা এক বছরে ছোট বোনের জন্য ঝুনঝুনি নিয়েছে।  নাগরদোলায়ও চড়েছে সে। বেশি মজা পেয়েছে সে নাগরদোলায়।



এদিকে নাটোরের বড়াইগ্রাম থেকে আসা খেলনা ব্যবসায়ী আমিনুল এবং কসমেটিক ব্যবসায়ী সাজ্জাদ আলী জানান, গত প্রায় ১০ বছর থেকে তারা এই মেলায় আসেন। প্রতিবছরই তাদের ব্যবসা ভালো হয়। দিনে কম করে হলেও ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বিক্রি করেন। তবে ঘোড়াদহ মেলাকে কেন্দ্র করে পাশের আলীপুর এবং অন্য একটি গ্রামে আরও দুইটি মেলা বসেছে এবার। এজন্য আগের মতো এই মেলার ভিড় নেই। তাই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে আগামী বছর ঘোড়াদহ মেলাকে কেন্দ্র করে আশপাশে অন্য কোনো গ্রামে যেন আর মেলা বসতে না দেওয়া হয় সেই দাবি করেন তারা।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২৩
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।