ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

‘মাটির বাটনা’ ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ উত্তরবঙ্গের হেঁশেল

মোমেনুর রশিদ সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০০ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০২৪
‘মাটির বাটনা’ ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ উত্তরবঙ্গের হেঁশেল

গাইবান্ধা: মৃৎশিল্পের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আদিকালের। একটা সময় তৈজসপত্র শুধুই মাটি দিয়ে তৈরি হতো।

বিশেষ করে গৃহবধূরা দৈনন্দিন জীবনে রান্নার জন্য মাটির চুলা, মাটির হাঁড়ি-পাতিল ব্যবহার করতেন। পানি রাখার জন্য মাটির কলস এবং ধান-চালের মতো শস্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার ছিল মাটির কোলা-ডাবর-মটকির।  

এছাড়া ঘর সাজানোর বিভিন্ন শো-পিস, গহনা, ফুলের টব, ফুলদানি, শিশুদের নানা রকম খেলনা, সবই ছিল মাটির। টাকা-পয়সা জমানো হতো মাটির ব্যাংকে।  

এসবই এখন হারিয়ে যাচ্ছে। মাটির জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, স্টিল।  

দৈনন্দিন জীবনে এসেছে আমূল পরিবর্তন। আজ রান্না হচ্ছে আগুনের পরিবর্তে ইলেট্রিক চুলায়। মাটির চুলার পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে গ্যাস, ইলেকট্রিক চুলা। আবার ‍চুলার পরিবর্তে এসেছে রাইস কুকার-কারি কুকার। দ্রুত কাজের জন্য রান্নাঘরে যুক্ত হয়েছে ব্লেন্ডার-গ্রাইন্ডারের মতো ইলেক্ট্রনিক পণ্য।

আজ ঠাণ্ডা পানির জন্য মাটির কলসের স্থলে পানি রাখা হচ্ছে ফ্রিজে। এতসব আধুনিকতার মাঝে আজও উত্তরবঙ্গের বেশির ভাগ বাড়ির হেঁশেলে (রান্নাঘর) নারীদের নিত্যসঙ্গী মাটির তৈরি বাটনা-পিষনি।  

বাটনায় মূলত মরিচ-মসলা বাটা হয়। এছাড়া যে কোনো ভর্তা করার জন্য বাটনার বিকল্প নেই। কারণ যে কোনো ভর্তা বাটনায় সহজে মিহি করে বাটা যায়। ফলে ভর্তা নরম হয়। এসব কাজে বাটনার সহায়ক হিসেবে কাজ করে বাঁশ বা কাঠের তৈরি নোড়া-পিষনি। এটা দিয়ে সহজেই বাটনায় বাটা-ভর্তা করা যায়।

সেই আদিকাল থেকে আজও সমান তালে চাহিদা রয়েছে বাটনার। সে কারণে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলার হাট-বাজারগুলোতে বাটনার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।  

রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী পৌর শহরের কালিবাড়ী হাট ঘুরে দেখা যায়, স্থানীয় কালিমন্দির চত্ত্বরে সপ্তাহের সাতদিনই মাটির তৈরি নানা পণ্যের পসরা নিয়ে বসেন মৃৎশিল্পীরা। সেখানে ক্রেতাদের অধিকাংশই নারী এবং বাটনা-পিষনির ক্রেতা। বিক্রেতারা এক হাতে ছোট লাঠি আর আরেক হাতে বাটনা নিয়ে টুং-টাং শব্দ করছেন। সেই শব্দ শুনেই থেকে অভিজ্ঞ নারী বুঝে নিচ্ছেন মাটির কোন বাটনাটি ভালো করে পোড়ানো হয়েছে। এভাবে বিক্রি হচ্ছে বাটনা।  

বাটনা কিনতে এসেছিলেন পৌর শহরের বাসিন্দা শামীমা আক্তার ও উম্মে কুলসুম বেগম। তারা বলেন, বাঁকা বাঁশের গোড়া দিয়ে তৈরি নোড়া-পিষনি দিয়ে বাটনায় মূলত মসলা-মরিচ বাটা হয়। এছাড়া এটা যে কোন ভর্তা করার জন্য বিশেষ উপযোগী। বাটনায় যে কোনো ভর্তা করা অনেক সহজ। এছাড়া মাছ ঘষার কাজেও বাটনা ব্যবহার করা হয়। এর ধারে সহজেই মাছের আঁইশ উঠে যায় ও ভালো পরিষ্কার হয়। নিত্য ব্যবহার্য প্রায় সব কিছুতে পরিবর্তন-আধুনিকতা যুক্ত হলেও বাটনার বিকল্প তৈরি হয়নি। তাই আজও বাটনার প্রতি নির্ভরতা একটুও কমেনি গৃহিণীদের। তবে বিভিন্ন পর্বে বড় পরিসরে রান্নায় বাটনার বদলে শিলপাটার কদর বেড়ে যায়।

মৃৎশিল্পী-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাটনা তৈরির জন্য প্রথমত উপযুক্ত মাটি নির্বাচন করতে হয়। এরপর কাঁদামাটি দিয়ে নিপুণ হাতে বাটনা (দেখতে বড় থালার মতো) তৈরির পর খোদাই-ধার দিয়ে তা রোদে ভালোভাবে শুকাতে হয়। এরপর আগুনে পুড়িয়ে ব্যবহারের উপযোগী করা হয় বাটনাকে।  

এদিকে বাটনার সহায়ক হিসেবে তৈরি করতে হয় নোড়া-পিষনি। এটা তৈরির জন্য বাঁশের প্রয়োজন। মাখলা নামে এক ধরনের বাঁশের গোড়া দিয়ে নোড়া তৈরি করা হয়। এজন্য বাঁকা বাঁশের গোড়া নির্বাচন করতে হবে। এরপর এটাকে কেটে মাপ করে ছিলতে হবে যেন এর হাতল মশৃণ হয় ও ধরতে সুবিধা হয়। এরপর রোদে শুকাতে হবে। এটি হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে আলু-মরিচ বাটনায় রেখে চাপ দিয়ে এপাশ-ওপাশ করলে সহজেই মিহি হয়ে যায়। একটি বাঁশের নোড়া ১৫-২০ বছর টেকে। যদিও নোড়া কাঠ দিয়েও বানানো হয়। অপরদিকে বাটনা যেহেতু মাটির তৈরি, তাই সাবধানে ব্যবহার করলে টিকে থাকে দীর্ঘদিন।  

বাটনা-নোড়ার দাম সম্পর্কে বিক্রেতারা জানান, বড় প্রতিটি  বাটনার দাম ৪৫ টাকা, মাঝারি বাটনার দাম ৩৫ টাকা এবং ছোটগুলোর দাম ২০ টাকা। এছাড়া প্রতিটি বাঁশের নোড়া ৮০ টাকায় এবং কাঠের ৫০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০২৪
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।