ঢাকা: খাদ্য উৎপাদন থকে শুরু করে খাবারের টেবিল পর্যন্ত আসার প্রতিটি ক্ষেত্রে গলদ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান।
তিনি বলেছেন, এসব গলদ চিহ্নিত করে কমাতে না পারলে নিরাপদ খাদ্য দেওয়া সম্ভব নয়।
বৃহস্পতিবার (২২ জুন) বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস-২০২৩ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে যৌথভাবে এই বৈঠকের আয়োজন করে পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র ও ফুড সেইফটি মুভমেন্ট।
ভোক্তার ডিজি বলেন, বিদেশে কোনো কিছুই খোলা পাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের এখানে অনেক কিছু খোলা পাওয়া যায়। এখন মাঠ থেকে তোলার পর সবজিটি যে পানিতে ধোয়া হচ্ছে, সেটি কি বিশুদ্ধ? মুরগিকে যে খাবার খাওয়ানো হচ্ছে, সেটি কতখানি মানসম্মত? এগুলোতে ফুড চেইনের মাধ্যমে আমাদের শরীরেই তো যাচ্ছে। রান্নাঘর থেকে খাবার টেবিলে খাবার আসা পর্যন্ত অনেক অনেক শিক্ষার অভাব আছে। অর্থাৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই গলদ রয়েছে। এসব গলদ চিহ্নিত করে কমাতে না পারলে নিরাপদ খাদ্য দেওয়া সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের অনেক অর্জন আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্জন আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। সবাই এর প্রশংসা করছে। কিন্তু যে খাবারটা হাত থেকে মুখে আসবে সেটা আমরা কতটা নিরাপদ করতে পেরেছি? যখন আমরা উন্নয়নের কথা বলছি, তখন আবার খাদ্য নিরাপদ করার কথা বলে বেড়ানো দুর্ভাগ্যজনক। খাদ্য তো নিরাপদই হবে। অনিরাপদ খাদ্য তো খাদ্য নয়। এটি অখাদ্য।
তিনি আরও বলেন, দেশের মানুষের নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকারের জন্য অনেক আইন-কানুন আছে, অনেকগুলো সংস্থা আছে, অনেকগুলো মন্ত্রণালয় আছে, বিভাগ আছে। আমরা সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সবাই মিলে কাজ করছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কতগুলো খাদ্য আমরা নিরাপদ করতে পেরেছি? কৃষক যে মাটিতে খাদ্য উৎপাদন করছে, সেটি কি আমরা নিরাপদ করতে পেরেছি? ধানে অতিমাত্রায় হেভি মেটাল পাওয়া গেছে। আমাদের নদীগুলো দূষিত হয়ে গেছে। সেই পানি ব্যবহারের কারণে ধানে হেভি মেটাল পাওয়া যাচ্ছে।
আমরা পরিবেশ-প্রতিবেশকে প্রতিনিয়ত গলা টিপে ধ্বংস করছি মন্তব্য করে এ. এইচ. এম সফিকুজ্জামান আরও বলেন, আমরা যে মাটি বা পানি ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন করছি, সেটিতেই সমস্যা রয়েছে। মাটির যে গুণাগুণ সেটি আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। আমরা অতিমাত্রায় কীটনাশক, সার ব্যবহার করছি। উৎপাদন বাড়াতে গেলে আমাদের এসব কীটনাশক, সার ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু কতটুকু জমিতে কতটুকু সার বা কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে সেই জ্ঞানটি কি আমাদের কৃষকদের দিতে পেরেছি? এই জায়গাগুলোতে আমাদের প্রথম কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, খাদ্য নিরাপদ না হওয়ায় আমরা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগছি। এখন প্রতিটি ঘরে ঘরে ক্যান্সার রোগী, কিডনি রোগী। এগুলো নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ না করার প্রভাব। খাদ্যকে নিরাপদ করতে সবাইকে সচেতন করতে হবে। এই কাজটি আমাদের সবাইকে সমন্বিতভাবে করতে হবে। পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্যের অধিকার আদায়ে সবাইকে যার যার জায়গা থেকে সোচ্চার হতে হবে। নইলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে।
আলোকিত নারী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. মেহেরুন নিছা মেহরীনের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. রেজাউল করিম, পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালক মুহাম্মদ রিসালাত সিদ্দীক ও ফুড সেইফটি মুভমেন্টের সভাপতি সাদেক মোহাম্মদ খান।
মো. রেজাউল করিম বলেন, মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য নিরাপদ খাদ্য দরকার। এটি তার অধিকার। সেটি নিশ্চিত করতে হবে গবেষণা করে বৈজ্ঞানিকভাবে। এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা। ২০ সেকেন্ড হাত ধোয়ার কার্যকারিতা সম্পর্কে আমরা জানিই না। অথচ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত না করে শুধু মেট্রোরেল আর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে উন্নত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়।
মুহাম্মদ রিসালাত সিদ্দীক বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি এবং শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে যদি আমরা সাফল্য অর্জন করতে পারি, তাহলে নিরাপদ খাদ্য কেন নিশ্চিত করতে পারবো না? যদি নিরাপদ, মানসম্মত ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে এসব সাফল্য ধরে রাখা যাবে না।
সাদেক মোহাম্মদ খান বলেন, আজকে শিশুদের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দিলে তারাই আগামীতে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে।
ফুড সেইফটি মুভমেন্টের সাধারণ সম্পাদক মো. ইউনুস আলীর স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হওয়া বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের যুগ্ম পরিচালক (প্রোগ্রাম) মো. মনিরুজ্জামান সিদ্দীক।
‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ একটি সম্মিলিত দায়িত্ব’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, এ বছর বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবসের স্লোগান হলো- ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত সবার দায়িত্ব। আপনি কে বা কি করেন সেটি ব্যাপার নয়। খাওয়ার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করাই গুরুত্বপূর্ণ। ’ এ বছর দিবসটির থিম হলো- ‘খাদ্যের মান বাঁচায় জীবন’। এ বছর বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবসে খাদ্য উৎপাদকারী, ভোক্তা এবং অন্যান্য অংশীদাদের মধ্যে সহযোগিতা, উদ্ভাবন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবার অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। একইসঙ্গে ঝুঁকি কমাতে এবং আমাদের খাদ্য সরবরাহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো, কার্যকর মনিটরিং সিস্টেম এবং ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচারণার গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিশ্বব্যাপী নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো হলো- দুর্বল নিয়ন্ত্রণ কাঠামো, সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব, অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো, দুর্বল কৃষি পদ্ধতি, অনিরাপদ পানি, অপর্যাপ্ত খাদ্য পরীক্ষাগার ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, অনানুষ্ঠানিক খাদ্য সেক্টর এবং বিশ্বায়ন এবং বাণিজ্য।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত মূল প্রবন্ধে ৮টি সুপারিশ করেন তিনি। সেগুলো হলো- নিরাপদ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কাঠামো শক্তিশালীকরণ, খাদ্য নিরাাপত্তা শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি, ভালো কৃষি পদ্ধতি তৈরি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়ন, খাদ্য পরীক্ষা ও নজরদারি জোরদারকরণ, সরকারি-বেসরকারি সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয়, ট্রেসেবিলিটি এবং রিকল সিস্টেম উন্নত করা, গবেষণা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি।
বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০২৩
এসসি