ঢাকা: বর্ষাকালে সাপের উপদ্রব বেশি দেখা যায়। এর বাইরেও সারা বছরই সাপের কামড়ে অনেকে আক্রান্ত হন এবং মারা যান।
বর্ষাকালে মাঠ-ঘাট ফসলের জমি যখন প্লাবিত হয়, তখন সাপ তার আবাসস্থল হারিয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে আশ্রয় ও খাবারের খোঁজে মানুষের বসতভিটা, বাড়ি-ঘর, উঁচু স্থান, রাস্তার পাড়, বেড়িবাঁধ, গাছ, খড়ের গাদাসহ শুকনো জায়গায় আশ্রয় গ্রহণ করে। এর ফলে সাপে এবং মানুষের সংঘাত সৃষ্টি হয়। তাই এই সময়ে কখনও সাপের কামড়ে মানুষ, আবার কখনও মানুষের আঘাতে সাপ মারা যায়। মনে রাখা দরকার, প্রতিটা মানুষের জীবন যেমন দামি, তেমনি প্রকৃতি এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সাপের ভূমিকাও অপরিসীম। তাই বর্ষাকালে সাবধানতা এবং সচেতনতাই সাপ এবং মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা কমতে পারে।
সম্প্রতি সরকারি এক গবেষণায় থেকে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর ৪ লাখেরও বেশি (৪ লাখ ৩ হাজার ৩১৭) মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন। মৃত্যু হয় সাড়ে ৭ হাজারের বেশি (৭ হাজার ৫১১ জন) মানুষের। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়।
দেশে প্রতিবছর প্রতি লাখে ২৪৪ জন সাপের কামড়ের শিকার হন। মারা যায় প্রায় ৫ জন। দুর্ঘটনার ৪ ভাগের এক ভাগ বিষাক্ত সাপের কামড়ে হয়ে থাকে। মোট আক্রান্তের ৯৫ ভাগই গ্রামের বাসিন্দা।
চিকিৎসক ও সাপ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরীসৃপ এ প্রাণীর কামড়ে আক্রান্ত হওয়ার পর বেশির ভাগ সময় আক্রান্ত ব্যক্তি আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। আক্রান্ত ব্যক্তিকে আশ্বস্ত করতে হবে, ভয়ের কিছু নেই। এর চিকিৎসা রয়েছে। সাপের কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো ওঝা বা কবিরাজের কাছে নিয়ে সময় নষ্ট করার পরিবর্তে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। প্রায় প্রতিটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা জেলা সদর হাসপাতালে সাপের কামড়ের প্রতিষেধক (অ্যান্টিভেনাম) থাকে।
বন্যার সময় সাপের দংশন থেকে বাঁচার উপায় সম্বন্ধে জানতে চাইলে বন্যপ্রাণী এবং সাপ বিষয়ে গবেষণা করা আবু সাঈদ বাংলানিউজকে বলেন, বন্যার সময় বাড়িঘরের আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন মালামাল সরানো বা পরিষ্কার করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেসব ঘরের সিলিং রয়েছে সেগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হবে। সেখানেও সাপ লুকিয়ে থাকতে পারে। খড়ের গাদা এবং খড়ির স্তূপে সাপ লুকিয়ে থাকতে পারে। এগুলো সংগ্রহের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রাতের বেলা চলাফেরা করার সময় অবশ্যই আলো (টর্চ-লাইট) ব্যবহার করতে হবে। অনেকেই রাতের বেলা মাছ ধরতে গিয়ে সর্প-দংশনের শিকার হতে পারে। সুতরাং টর্চ বা আলো ছাড়া মাছ শিকারে বের হবেন না।
তিনি আরও বলেন, রাতে ঘুমানোর আগে বিছানা ভালোভাবে পরীক্ষা করে সম্ভব হলে মশারি টানিয়ে বিছানার সাথে গুঁজে ঘুমাতে হবে। মাটিতে ঘুমানো পরিহার করতে হবে। ঘরের মধ্যে লাইফবয় সাবানের টুকরো, কার্বলিক অ্যাসিড দিয়ে সাপ প্রতিরোধ করা যায় না। এগুলোর কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেই। প্রয়োজনে ঘরের চারিদিকে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিলে সাপের আনাগোনা কম হতে পারে। যেইসব বাড়ি ঘরে বর্ষাকালে বা বন্যার সময় সাপের আনাগোনা বেড়ে যায়, সেসব বাড়ি-ঘরের চারদিকে মাছ ধরার জাল দিয়ে ঘেরাও করে রাখলে সাপ ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। রাতে টয়লেটে যাওয়ার সময় অবশ্যই টর্চ ব্যবহার করতে হবে।
সতর্কতা অবলম্বন বিষয়ে তিনি আরও বলেন, বাড়ির আশপাশে যেকোনো প্রকার ছোট-বড় গর্ত থাকলে তা বন্ধ করে দিতে হবে। বাড়ি ঘরের আশেপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা; সাপ নিরিবিলি স্থান পেলে সেখানে আশ্রয় নিতে পারে, তাই ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র মাটি থেকে একটু উঁচুতে রাখতে হবে। ঘরে যেসব স্থানে আমরা ধান-চাল রাখি, সেগুলো খাবার জন্য ইঁদুর চলে আসে। ইঁদুর শিকারের লোভে সাপও ঘরের মধ্যে চলে আসতে পারে। সুতরাং বসতভিটা ইঁদুর এবং ব্যাঙ মুক্ত রাখতে হবে। হাঁড়ি-পাতিল কিংবা মাটির কলস জাতীয় জিনিস খোলা না রেখে ঢাকনা ব্যবহার করতে হবে। কেউ যদি সর্প-দংশনের শিকার হয় ওঝা-বৈদ্যের কাছে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট না করে তাকে দ্রুত নিকটস্থ সরকারি সদর ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
সাপের কামড়ের প্রতিষেধক অ্যান্টিভেনাম কোথায় কোথায় পাওয়া যায় জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, অ্যান্টিভেনাম আমরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যন্ত প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গত বছর আমরা যে পরিমাণ অ্যান্টিভেনাম দিয়েছিলাম, সেগুলো অব্যবহৃত হওয়ায় কিছু কিছু অ্যান্টিভেনামের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। সেসব স্থানে আমরা আবার নতুন অ্যান্টিভেনামের দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে অ্যান্টিভেনামের দাম অনেক বেড়ে গেছে, কোনো ক্ষেত্রে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তাই আগে আমরা যে পরিমাণ অ্যান্টিভেনাম কিনতে পারতাম এখন সেই পরিমাণে পারছি না বাজেট না বাড়ায়। এবার অর্ধের কিনতে পারব। তাই অ্যান্টিভেনামের কিছুটা সমস্যায় আমরা আছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছেও আমরা অ্যান্টিভেনাম চেয়েছি, তারাও দিতে চেয়েছে। এখন সেটা আসতে কত সময় লাগে সেটাই দেখার বিষয়। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে উপজেলা পর্যন্ত অ্যান্টিভেনাম পৌঁছে দেওয়া।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অ্যান্টিভেনাম ইনজেকশন দেওয়া এবং সাপে কাটা রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার মতো প্রশিক্ষিত চিকিৎসক রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে। আমরা রেগুলার চিকিৎসকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সরাসরি এবং এক বছর ধরে আমরা অনলাইনে এ বিষয়ে প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। প্রায় প্রতিটা প্রশিক্ষণে আমি এবং স্নেক বাইট বিশেষজ্ঞরা প্রায় প্রত্যেকে উপস্থিত থাকেন। এই প্রশিক্ষণ প্রতি মাসের প্রথম বুধবার দুপুর বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়।
সাপে কাটা রোগীর বিষয়ে মানুষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে আরও বেশি প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। রোগীকে উপজেলা বা জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়ার বিকল্প নেই বলেও উল্লেখে করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪০ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০২৩
আরকেআর/এমজে