ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ মে ২০২৪, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

শীতের রাতে পাল্লা দিয়ে ছিন্নমূলের কষ্ট বাড়ে

সুব্রত চন্দ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০২৪
শীতের রাতে পাল্লা দিয়ে ছিন্নমূলের কষ্ট বাড়ে ছবিও তুলেছেন স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সুব্রত চন্দ। বাংলানিউজ

ঢাকা: বাংলা দিনপঞ্জিকা অনুযায়ী পৌষ মাস প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু রাজধানীতে এখনও জেঁকে বসেনি শীত।

গত তিন-চারদিন ধরে তাপমাত্রার পারদ নামছে। থেমে থেমে বইছে হিমেল হাওয়া। শীতের অনুভূতি শুরু হওয়ায় বিত্তবানদের অনেকে খুশি হলেও, কষ্টে পড়েছে ছিন্নমূলরা। শীতের রাতে পাল্লা দিয় তাদের কষ্ট বাড়ে।

রাজধানীর ছিন্নমূলদের প্রায় সবারই রাত কাটে প্রধান সড়কের পাশে ফুটপাতের ওপর, অলিগলির দোকানের সামনে বা বিভিন্ন পার্কে। শীত নিবারণের জন্য তাদের অনেকেরই থাকে না পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। যে কারণে রাতে শীত বেড়ে যায়, নিদারুণ কষ্টে পড়তে হয় ছিন্নমূল মানুষকে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বুধবার (৩ ডিসেম্বর) মধ্যরাত থেকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) সকাল পর্যন্ত সারা দেশে মাঝারি থেকে অতি ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। দেশের কোথা কোথাও এ অবস্থায় দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। অতি ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ও সড়ক যোগাযোগে বিঘ্ন হতে পারে। সারা দেশে রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে। অতি ঘন কুয়াশার কারণে দিনে ঠাণ্ডা পরিস্থিতি বিরাজ করতে পারে।

ছবিও তুলেছেন স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সুব্রত চন্দ।  বাংলানিউজএ অবস্থায় ছিন্নমূল মানুষদের দুর্ভোগ বাড়বে বৈ কমবে না। রাতে রাজধানীর হাইকোর্ট, রমনা, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট এলাকায় গেলে দেখা যায়, অসংখ্য ছিন্নমূল মানুষ রাস্তার পাশে ঘুমের ব্যবস্থা করছেন। কেউ ফুটপাতে বসে, কেউ শুয়ে আছে। তাদের অধিকাংশের কাছে শীত নিবারণে পর্যাপ্ত পোশাক থাকে না। ঠাণ্ডার অনুভূতি থেকে বাঁচতে কেউ কেউ আগুন জ্বালিয়ে তাপ নেন। কেউ প্লাস্টিকের ব্যানার দিয়ে তৈরি করছেন খুপরি ঘর তৈরি করে রাত কাটান।

তেমনি একজন ছিন্নমূল নারী জুলেখা। নিজের সঠিক বয়সও জানেন না তিনি। দেখে মনে হবে ৭৫-৮০ বছর বয়সী প্রৌঢ়া। তিনি সাধারণত বাংলামোটরের সোনারগাঁও রোডে পান্থকুঞ্জ পার্কের পাশে ফুটপাতে ঘুমান। প্লাস্টিকের পলিথিন দিয়ে ঘর তৈরি করে থাকেন। শীতবস্ত্র বলতে তার আছে একটি মাত্র চাদর। আর সেই চাদর গায়ে দিয়েই রাতে ঘুমিয়ে পড়েন।

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপের সময় জুলেখা বলেন, শীতের দিন শীত, গরমের দিন গরম লাগবোই। আমাগো মতো গরিবের গায়ের ঠাণ্ডা তো আর কেউ পাইবো না। আল্লায় (আল্লাহ) যেমনে রাখব হেমনেই থাকতে হইবো। কিছু করার নাই।

জুলেখার বাড়ি কিশোরগঞ্জে। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন বহু বছর আগে। তখন বস্তিতে ভাড়া বাসায় থাকতেন। ৩০ বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর ঠাঁই হয় ফুটপাতে। বাসা বাড়িতে কাজ করতেন। এখন বয়সের ভারে পারেন না। ১৫ বছর ধরে ভিক্ষা করেই জীবন যাপন করছেন।

ছবিও তুলেছেন স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সুব্রত চন্দ।  বাংলানিউজদুদিন আগে রাতের দিকে রমনা এলাকার পুরানো এলিফ্যান্ট রোডে গিয়ে দেখা যায় রমনা থানা মসজিদের পাশে ফুটপাতে বসে আছেন ১০-১২ জন ছিন্নমূল মানুষ। তাদের কেউ কেউ নিচ্ছিলেন ঘুমানোর প্রস্তুতি। সেখানে কথা হয় শাহীনের সঙ্গে। স্ত্রী রুবাকে নিয়ে ফুটপাতে বসে ছিলেন তিনি। দুজনেই রাস্তায় ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করেন।

শাহীন বলেন, দেশে বাড়ি ঘর নাই। ছোট থেকে ঢাকায় বড় হইসি। আগে রিশকা (রিকশা) চালাইতাম। কয়েকদিন আগে অ্যাসকিডেন (অ্যাকসিডেন্ট) কইরা বুকে ব্যথা পাইসি। অহনে রাস্তায় ঝাড়ু দেই। থাকার জায়গা নাই দেইখ্যা ফুটপাতে ঘুমাই। শীতে কষ্ট হইলেও কিছু করার নাই। এইডা আমাগো ভাগ্য। কয়েক বছর আগে মাইনষ্যে কম্বল দিসিলো। এইবারকা কেউ দেয় নাই। ফুটপাতে কাগজ ফালায়া রাইতে ঘুমাই।

এর আগে সন্ধ্যায় হাইকোর্ট মোড়ে কথা হয় প্রায় ৯০ বছর বয়সী জমিলা খাতুনের সঙ্গে। গুলিস্তান-হাইকোর্ট এলাকায় ভিক্ষা করেন তিনি। মো. গোলাম মোস্তফাও একই এলাকায় প্রতিবন্ধী স্ত্রীকে নিয়ে ভিক্ষা করেন। তাদের সবারই শীতের রাতে কষ্ট হয়। ভিক্ষা না পেলে খাবার জোটে না, যা পান তা দিয়ে শীতবস্ত্র কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। তাদের আক্ষেপ মানুষ কত টাকা এদিক সেদিক নষ্ট করে। তা না করে যদি তাদের জন্য কিছু করতো, তাহলে হয়ত অন্তত শীতকালটা তারা দুর্ভোগ ছাড়া কাটাতে পারতেন।

ছবিও তুলেছেন স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সুব্রত চন্দ।  বাংলানিউজএ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, সরকার সব সময়ই বলে আসে দেশে সেভাবে ভিক্ষুক বা দরিদ্র মানুষ নেই। সরকারের এ কথার কারণে সাধারণ মানুষও ধরে নেয়, দেশে দরিদ্র মানুষ নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থীরা বা ক্ষমতাবান বা বিত্তবানরা হয়তো তাদের (ছিন্নমূল) লোক দেখানো কিছু কম্বল দেয়। কিন্তু এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, কোনো মানুষ যাতে শীতে কষ্ট না পায়। কারণ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই এগুলো দেওয়া রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এসব মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের কোনো তাগাদা এখন পর্যন্ত নেই।

বিত্তবানদেরও ছিন্নমূলদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তবে এটা শুধুমাত্র যেন একটি মৌসুম কেন্দ্রিক না হয়। যদি স্থায়ী সমাধান করা যায় তাহলে সেটা টেকসই হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০২৩
এসসি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।