ঢাকা, মঙ্গলবার, ২ পৌষ ১৪৩১, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

রমজান সামনে রেখে বাড়ছে মসলার ঝাঁজ 

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০২৪
রমজান সামনে রেখে বাড়ছে মসলার ঝাঁজ 

ঢাকা: পবিত্র রমজানের বাকি কয়েক মাস। এ মাস এলেই মসলার চাহিদা বেড়ে যায়।

সে কারণে এখন থেকেই ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। কিন্তু এরইমধ্যে মসলার বাজার ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষ করে এলাচের দাম বাড়ছে লাফিয়ে।  

অন্যান্য মসলার মধ্যে জিরা, গোলমরিচ, কাজুবাদাম, জয়ত্রী, জায়ফলের দামও বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অতিরিক্ত ট্যাক্স (কর), আন্তর্জাতিক বাজারে মসলার দাম বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য তারা আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। একই সঙ্গে ভারত থেকে আমদানি কমার কারণেও মসলার দাম বেড়েছে।

মসলার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারসহ কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেড় থেকে দুই মাসের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে এলাচের দাম। দুই মাস আগে প্রতি কেজি এলাচের দাম ছিল এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা। এখন তা বেড়ে তিন হাজার ৮৫০ টাকা থেকে চার হাজার ৪৫০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে।  

জিরার দাম ছয় মাস আগে আরও বেশি ছিল। তখন প্রতি কেজি জিরার দাম হাজার টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে কিছুটা কমে পাইকারিতে ৬২০ টাকা এবং খুচরায় ৮৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। তবে বছর দুয়েক আগেও ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি জিরার দাম ছিল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।  

দুই মাস আগে প্রকারভেদে প্রতি কেজি গোলমরিচের দাম ছিল ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৮২০ টাকা থেকে এক হাজার ৩৫০ টাকায়। প্রকারভেদে কাজুবাদামের প্রতি কেজির দাম এক হাজার ৩৫০ থেকে এক হাজার ৬৮০ টাকা, যা আগে ছিল এক হাজার ২৫০ থেকে এক হাজার ৪৫০ টাকা।  

মৌলভীবাজারের সাথী এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী মো. সালাম বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে বেচাকেনা তলানিতে ঠেকেছে। আগে যে ক্রেতা পাঁচ কেজি মসলা নিতেন এখন তিনি নিচ্ছেন দুই কেজি মসলা। আসলে মানুষের হাতে বর্তমানে টাকা নেই। কয়েক মাস পরই রমজান শুরু হবে। তখন মসলার চাহিদা বাড়বে।

তিনি বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর ভারত থেকে বৈধ পথে কোনো মসলা আসছে না। আবার ডলারের দাম বেশি হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী পরিমাণে কম আমদানি করছেন। ফলে কিছু এলাচ, গোলমরিচ, কাজুবাদামসহ কিছু মসলার দাম বেড়েছে। বাজারে সরবরাহ আছে, আমদানিও হচ্ছে। তারপরও দাম কেন বাড়ছে বুঝতে পারছি না।  

খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি জাফরান এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল এক লাখ টাকা। এলাচ এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা ছিল। তা বেড়ে হয়েছে চার হাজার থেকে চার হাজার ৬০০ টাকা।  

সাদা গোলমরিচের কেজি এক হাজার ১৬০ টাকা থেকে বেড়ে এক হাজার ২৮০ টাকা, কালো গোলমরিচ ৮৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৯৬০ টাকা, সাদা গোলমরিচ এক হাজার ৪৫০ টাকা, শাহী জিরা এক হাজার টাকা থেকে বেড়ে এক হাজার ২০০ টাকা, জয়ত্রী দুই হাজার ৪৫০ থেকে বেড়ে দুই হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

জায়ফলের কেজি ৬৫০ থেকে বেড়ে এক হাজার ৫০ টাকা, কালোজিরা ৩৬০ থেকে বেড়ে ৩৮০ টাকা, সরিষা ১২০ থেকে বেড়ে ১৪০ টাকা, কাজুবাদাম এক হাজার ২০০ থেকে বেড়ে এক হাজার ৬০০ টাকা, কাঠবাদাম ৯০০ থেকে বেড়ে এক হাজার ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তবে পেস্তাবাদাম দুই হাজার ৭০০ টাকা থেকে কমে দুই হাজার ৪৫০ টাকা, চিনাবাদাম ১৪০ থেকে কমে ১২০ টাকা, জিরা প্রকার ভেদে ৮০০ থেকে এক হাজার  টাকা থেকে কমে ৬১০ থেকে ৮২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।  

আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে লবঙ্গ এক হাজার ২৬০ টাকা, দারুচিনি ৪৪০ টাকা। এ ছাড়া কিশমিশ ৬২০ থেকে কমে ৫৭০ টাকা, আলুবোখারা ৪৬০ থেকে কমে ৩৯০ টাকা এবং ইসবগুল এক হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা থেকে কমে ৯৪০ থেকে এক হাজার ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

এ বিষয়ে সূত্রাপুর বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী আদনান অ্যান্ড আরাফাত ট্রেডার্সের মালিক মো. ফারুক হোসাইন বাংলানিউজকে বলেন, ভারত থেকে বৈধ পথে বর্তমানে কোনো মসলা আসছে না, আবার ডলারের দামও বেশি। ফলে দেশে মসলার আমদানি কমেছে। কিন্তু ভারত থেকে চোরাই পথে মসলা আসছে। এজন্য বাজারে মসলার সরবরাহ আছে। তারপরও কেন দাম বাড়ছে জানি না। আমরা পাইকারি বাজার থেকে বেশি দামে পণ্য আনি। আর বেশি দামে বিক্রি করি। আমাদের লাভ খুব সীমিত। আর বেচা-বিক্রি অনেক কমে গেছে। এভাবে ব্যবসা করে টেকা কঠিন।

মৌলভীবাজারের হেদায়েত অ্যান্ড ব্রাদার্সের ম্যানেজার মো. বিলাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ব্যবসার পরিস্থিতি তেমন ভালো না। ক্রেতা কমে গেছে। মানুষ এখন অস্থির সময় পার করছে। বর্তমানে এলাচের দাম অনেক বেড়েছে। ভারতের জিরা এখন সরাসরি আসে না। ব্ল্যাকে আসে। ফলে বাজারে সরবরাহ থাকলেও কিছুদিন পরে তা যখন কড়াকড়ি হবে, তখন জিরার দামও বাড়বে। আসলে সবকিছু নির্ভর করে ডলারের ওপর।

তিনি বলেন, আসলে কিছু লোক সিন্ডিকেট করে ঈদের দুই মাস আগেই মসলার দাম বাড়িয়ে দেয়। পরে ঈদের আগে কিছু দাম কমিয়ে সরকারের কাছ থেকে বাহবা নেয়। ঈদ আসার পর সেখান থেকে ২০ টাকা ৩০ টাকা কমাবে। আর বলবে, মসলার দাম কমেছে। কিন্তু আগেই তো মসলার দাম যা বাড়ানোর, তা বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে, এবং ব্যবসা যা করার করে নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এনায়েত উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, গত দুই তিন মাস ধরেই মসলার দাম বাড়ছে। আমদানিতে অতিরিক্ত কর দিতে হচ্ছে। আবার ভারত থেকে আমদানি বন্ধ থাকায় বাজারে একটু ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের মসলার দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে ডলারের দাম দিন দিন বাড়ছেই।  

তিনি বলেন, যেহেতু মসলা আমাদের আমদানির ওপরই নির্ভর করতে হয়। তাই ডলারের দামের সঙ্গে পণ্যের দামও উঠা-নামা করে। যদি শুল্কায়নের ক্ষেত্রে বছরব্যাপী একই নীতি অনুসরণ করা যায়, তাহলে মসলার বাজার আরও স্থিতিশীল হবে। মসলা-জাতীয় পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে এলাচ, জিরা, গোলমরিচের। অন্যান্য পণ্য সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।  

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. গোলাম মাওলা বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের মসলার বাজার আমদানি-নির্ভর হওয়ায় তা বিদেশের বাজার পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। আন্তর্জাতিক বাজারেই মসলার দাম বেশি। আর আমদানি করতে দিতে হয় অতিরিক্ত কর। ৫৭০ টাকা ট্যাক্স দিতে হয় শুধু এক কেজি এলাচ আমদানি করতে।  

তিনি বলেন, সরকার একদিকে বলবে দাম স্থিতিশীল রাখো, অন্যদিকে অতিরিক্ত ট্যাক্স বসিয়ে রাখবে। তাহলে দাম কীভাবে কমবে? এ ছাড়া গত কয়েক বছর ধরে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা মসলা আমদানিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে বর্ডার (সীমান্ত) বন্ধ থাকায় ভারতের পণ্য আসছে না। তার একটি প্রভাব বাজারে পড়েছে। মূলত এসব কারণেই দাম বাড়ছে মসলার।  

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০২৪
জিসিজি/আরএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।