ঢাকা, সোমবার, ১৫ পৌষ ১৪৩১, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

সিরাজ মাস্টারের এক ইশারায় ৫ জনকে হত্যা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৫
সিরাজ মাস্টারের এক ইশারায় ৫ জনকে হত্যা

ঢাকা: একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিরাজ মাস্টারের হাতের ইশারায় নিরস্ত্র পাঁচজনকে ধরে  গুলি করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয় রাজাকাররা। এ সময় আমিসহ তিনজন দূর থেকে দেখি, সিরাজ মাস্টারের ইশারায় সতীশ চন্দ্র মণ্ডল, হাশেম আলী শেখ, বাবু খান, নজরুল ইসলাম ও মনিন্দ্র নাথ সাহাকে ধরে নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।

পরে তাদের মরদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বাগেরহাটের শেখ সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানকালে এসব কথা বলেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজর আহমেদ। তিনি সিরাজ মাস্টার, লতিফ তালুকদার ও খান আকরামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১২তম সাক্ষী।

মঙ্গলবার (১৩ জানুয়ারি) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দু’দিনব্যাপী দেওয়া সাক্ষ্য শেষ করেন ফজর আহমেদ। সাক্ষ্যগ্রহণে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন। সাক্ষ্য শেষে সাক্ষীকে জেরা করেছেন সিরাজ মাস্টারের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান এবং খান আকরাম হোসেন ও আব্দুল লতিফ তালুকদারের আইনজীবী এম সারোয়ার হোসেন।

বুধবার (১৪ জানুয়ারি) সিরাজ-লতিফ-আকরামের বিরুদ্ধে ১৩তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
 
বর্তমানে আনুমানিক ৬৮ বছর বয়সী সাক্ষী ফজর আহমেদ বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার কচুয়া গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল আনুমানিক ২৬ বছর। সে সময় তিনি পাকিস্তান মুজাহিদ (আনসার) বাহিনীর সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতার পরে তিনি পূবালী ব্যাংকে চাকরি করতেন। বর্তমানে অবসরে আছেন।

সাক্ষী ফজর আহমেদ (৬৮) সাক্ষ্যে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশলাইনে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ করার সংবাদ পাই। তখন আমিসহ ১১ জন বাঙালি মোজাহিদ বাহিনীর সদস্য কর্মস্থল ত্যাগ করে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে এসে আমি আমার আত্মীয় আনসার কমান্ডার নুরুল হক এবং মীর সাখাওয়াত আলী দারুর সঙ্গে যোগাযোগ করি। স্থানীয় ছাত্র, যুবকদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য ৫০টি রাইফেল সংগ্রহ করতে বলি। তারা রাইফেল এনে দিলে আমরা ট্রেনিং শুরু করি।

সাক্ষী বলেন, ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল সকাল দশটার দিকে মওলানা একেএম ইউসুফসহ (যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত হলেও বিচার চলাকালে মৃত্যু হয়েছে) বেশ কয়েকজন থানা সদরে টিটিসি হলে একটি সভা করেন। সেই সভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম।   রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করতে যুবক ছেলেদের যোগদানের জন্য ইউসুফ ওই সভায় আহবান করেন। একই সঙ্গে তিনি হিন্দুদের বাড়ি-ঘর লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ করা জায়েজ বলে ঘোষণা করেন।

সাক্ষী ফজর আহমেদ বলেন, যারা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে চান তাদের নামের তালিকা তৈরি করতে নির্দেশ দেন ইউসুফ। এ নির্দেশে আব্দুল লতিফ তালুকদার, ইদ্রিস শেখ, আকরাম খান, হাশেম আলী শেখ, মনিরুজ্জামান, ইদ্রিস মোল্লা ও রুস্তম মোল্লা নাম অন্তর্ভূক্ত করান। তারা ১০ দিনের ট্রেনিং নিয়ে কচুয়ায় ফিরে দৈবজ্ঞহাটিতে একটি রাজাকার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। এ ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন আসামি আকরাম খান। এ সময় তারা এলাকায় গণহত্যা-নির্যাতন শুরু করেন।

সাক্ষী বলেন, এরপর আমি ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে বাগেরহাট সাব সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে ধোপাখালী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগদান করি।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর কচুয়া রাজাকার ক্যাম্পের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করি। এ সময় সংবাদ পাই যে, রাজাকাররা ৫ জন লোককে রাজাকার ক্যাম্পে ধরে এনেছে। ওই দিন বিকাল পাঁচটার দিকে সিরাজ মাস্টারের ইশারায় রাজাকাররা তাদেরকে নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়।   যা আমরা দূর থেকে দেখতে পাই। ওই সময় আমাদের সঙ্গে কোনো ভারি অস্ত্র না থাকায় ক্যাম্পে ফিরে আসি।

তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়ে সবশেষে ট্রাইব্যুনালের আসামির কাঠগড়ায় বসে থাকা তিন আসামি শেখ সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনকে শনাক্ত করেন সাক্ষী ফজর আহমেদ।

গত বছরের ৩ ডিসেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার পর সিরাজ-লতিফ-আকরামের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন আরও ১১ জন সাক্ষী। তারা হচ্ছেন দিলীপ দাস, শৈলেন্দ্র নাথ দাস, শহীদজায়া কমলা রানী চক্রবর্তী, তপন কুমার দাস, শহীদপুত্র অরুণ দাস, শহীদপুত্র নন্দলাল দাস, নিমাই চন্দ্র দাস, শহীদপুত্র আনন্দ লাল দাস।

গত বছরের ৩ ডিসেম্বর তিন আসামির বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন।

গত বছরের ৫ নভেম্বর রাজাকার কমান্ডার ‘বাগেরহাটের কসাই’ বলে কুখ্যাত সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার এবং তার দুই সহযোগী আব্দুল লতিফ তালুকদার ও আকরাম হোসেন খাঁনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোট সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়। তাদের মধ্যে সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে পাঁচটি এবং আব্দুল লতিফ ও খান আকরামের বিরুদ্ধে ৩টি করে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাগেরহাটের শাঁখারিকাঠি বাজার, রনজিৎপুর, ডাকরা ও কান্দাপাড়া গণহত্যাসহ ৮ শতাধিক মানুষকে হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন এবং শতাধিক বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ।

গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন। অন্যদিকে ৩০ সেপ্টেম্বর ও ২০ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন আব্দুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনের পক্ষে তাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার মীর সরোয়ার হোসেন এবং শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের পক্ষে তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল হাসান।

গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর এ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার অফিসে প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন ও শেখ মুশফিক কবির তাদের বিরুদ্ধে এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন।

তদন্ত চূড়ান্ত করে গত বছরের ২৫ আগস্ট এ তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশন বরাবর দাখিল করেন তদন্ত সংস্থা। তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার তদন্ত দল দীর্ঘ তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে এ চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রসিকিউশন এর ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন।
 
বাগেরহাটের এই তিন আসামির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ ৯টি ভলিউমে ৫ খণ্ডে কেস ডায়েরি করে অভিযোগ দাখিল করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ৯টি খণ্ডে মোট ৮শ’ ৪৪ পৃষ্ঠার তদন্তের ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ৬৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন তদন্ত সংস্থা।

ট্রাইব্যুনাল-১ গত বছরের ১০ জুন এ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ১১ জুন আব্দুল লতিফ তালুকদার, ১৯ জুন আকরাম হোসেন খাঁন ও ২১ জুলাই সিরাজ মাস্টারকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
 
তাদেরকে সেফহোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কচুয়ার শাঁখারিকাঠি বাজারে গণহত্যার শিকার রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহীদ জিতেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে নিমাই চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ২০০৯ সালে কচুয়া থানায় এ তিনজনসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।