২৭ মার্চ রাঙামাটি স্টেশন ক্লাবের মাঠে মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়। তৎকালীন পার্বত্যঞ্চলের জেলা প্রশাসক হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ.টি.ইমাম), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবদুস সামাদ, পুলিশ সুপার বজলুর রহমান এবং মহকুমা প্রশাসক আবদুল আলীসহ স্বাধীনতাকামী মানুষ এগিয়ে এলেন।
২৯ মার্চ রাঙামাটি হতে ৬০ জনের একটি দল প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য ভারতে রওনা হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ সরবরাহ, যানবাহনের জন্য রাঙামাটি আলম ডকইয়ার্ডে গড়ে উঠল মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প। এখানে স্থাপন করা হল ওয়ারলেস সেন্টার।
রাঙামাটি হতে ভারতে যাওয়া প্রথম মুক্তিযোদ্ধা দলটি এক সপ্তাহের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাপ্টেন আবদুল কাদেরের নেতৃত্বে ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ১৫ এপ্রিল রাঙামাটি আসে।
কিন্তু স্থানীয় লোকদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে প্রথম দলটি রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলো এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নিহত হয়।
দ্বিতীয় দলটি রাঙামাটি শহরের কাঁঠালতলীস্থ আলম ডকইয়ার্ডে উঠে সেখানে অবস্থান নেয় এবং তৃতীয় দলটি সদর এলাকার বাকছড়িতে অবস্থান গ্রহণ করে এবং পরদিন হানাদার বাহিনীর উপর হামলা চালায়।
৫ মে ১নম্বর সেক্টরের অধীন ২৫ সদস্যর পার্বত্য চট্টগ্রাম মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়। হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরাকে কোম্পানি কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। ১নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল রাঙামাটির বরকল উপজেলার হরিণায়।
১নং সেক্টরের অধীনে হরিণা থেকে ৩০ কিঃ মিঃ দূরবর্তী ভারতের বৈষ্ণবপুরে আগস্ট মাসের শুরতে সাব-সেক্টর স্থাপন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের বিএসএফ ট্রেনিং সেন্টার হতে ট্রেনিং প্রাপ্তদের একটি দল গ্রুপ কমান্ডার নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ৯ ডিসেম্বর কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া ও বালুখালীতে গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করলে গ্রুপ কমান্ডার নাজিম এবং মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ জাফর শহীদ হন।
১১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে বেতবুনিয়াস্থ চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কে অবস্থিত কালভার্টের উপর অতর্কিত ভাবে হানাদার বাহিনীর জিপ গাড়ির উপর গেরিলা আক্রমণ চালালে ঘটনাস্থলে গাড়ির ড্রাইভারসহ ২জন পাকিস্তানি অফিসারের মৃত্যু ঘটে।
এদিকে আগস্টের মধ্যভাগে পাইলট মান্নানসহ মুক্তি বাহিনীর একটি দল পাহাড়ি এলাকায় পথ হারিয়ে রাতের অন্ধকারে রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের পাকিস্থানবাহিনীর ক্যাম্পে ঢুকে পড়লে কয়েকজন স্থানীয়দের সহায়তায় বাঁচতে পারলেও বাকীরা নিহত হয়।
১৪ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় বিলাইছড়ি উপজেলারা ফারুয়া ইউনিয়নের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ২টি যুদ্ধবিমান আক্রমণ চালায়। সেখানে ৭৫০ জন হানাদার সেনার অবস্থান ছিল।
অন্যদিকে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী জৈলানন্দ সিং এবং সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর নেতৃত্বে ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা রাঙামাটির বরকলে উপজেলায় অগ্রসর হয়।
১৫ ডিসেম্বর মিত্র ও মুক্তিবাহিনীরা ভোরে হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করলে বিকেলে পাঞ্জাবিরা রাঙামাটির উদ্দেশ্যে পালিয়ে যায়। তাদের অনুসারী বাঙালি রাজাকার, আলবদর ও বেলুচ সৈন্যদের দলটি যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল মনীষ দেওয়ান বাংলানিউজকে জানান, ১৫ ডিসেম্বর সকালে ভারতের দেমাগ্রী থেকে কমান্ডার সুজান সিং উবানের নির্দেশে মেজর সুরীর নেতৃত্বে হেলিকপ্টার করে রাঙামাটির কুতুকছড়িতে আসলে আমাদের হেলিকপ্টারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিবর্ষণ করলে হেলিকপ্টার আক্রান্ত হয়। হেলিকপ্টারটি আমাদের কুতুকছড়িতে নামিয়ে দিয়ে আরও সৈন্য আনতে চলে যায়।
সেদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আমাদের লড়াই হলো। ১৬ ডিসেম্বর সকালে মেজর সুরী ও আমরা যখন পরিস্থিতি দেখতে বের হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আবারো গুলিবর্ষণ করে।
মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল মনীষ দেওয়ান আরও বলেন, ১৭ ডিসেম্বর সকালে বন্ধু শামসুদ্দীনকে নিয়ে রাঙামাটির কাউখালী উপজেলায় গেলে শুনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা পালিয়ে গেছে। ওইদিন দুপুরে রাঙামাটি শহরে এসে পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় আমি স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন করি- যোগ করেন এই মুক্তিযোদ্ধা।
১৮ ডিসেম্বর সকালে রাঙামাটিতে শেখ ফজলুল হক মণি, এসএম ইউসুফ, শেখ সেলিম, আমাদের কমান্ডার সুজান সিং ওভান আসেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৫১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৯
এসএইচ