ঢাকা, মঙ্গলবার, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২১ মে ২০২৪, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

পদ্মা সেতু: দুঃখ ঘুচবে বাগেরহাটের কৃষক ও মৎস্যচাষিদের

এস এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৬ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০২২
পদ্মা সেতু: দুঃখ ঘুচবে বাগেরহাটের কৃষক ও মৎস্যচাষিদের

বাগেরহাট: পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণের জেলা বাগেরহাটের সঙ্গে রাজধানীর নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হলো। এর মাধ্যমে বাগেরহাটের অর্থনীতি, পর্যটন, জীবন-মানে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হবে।

সঠিক মূল্য পাবেন বাগেরহাটের অবহেলিত কৃষক ও মৎস্যচাষিরা।

মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও সিন্ডিকেটের কবল থেকে মুক্তি পাবেন কৃষকরা। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন এমনটি মনে করছেন কৃষকরা।

পদ্মাসেতু দিয়ে কৃষকরা সহজেই তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য, সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি ও সাদা মাছ সহজেই ঢাকার বাজারে নিয়ে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারবেন। এতে একদিকে যেমন কৃষকরা লাভবান হবেন, অপরদিকে পণ্য নষ্ট হওয়ার শঙ্কাও কমে যাবে বহুগুন।  
 
কচুয়া উপজেলার কৃষক আবুল হোসেন বলেন, তিনটি ঘেরে গত বছর লাউ, ঢেঁড়স, মিস্টি কুমড়াসহ কয়েক প্রকার সবজির চাষ করি। ব্যাপক উৎপাদনও হয়। কিন্তু দেড় লাখ টাকা খরচে লাভ হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার টাকা। অথচ এই সবজি স্থানীয় ফড়িয়াদের কাছে না বিক্রি করে যদিঢাকায় পাঠাতে পারতাম লক্ষাধিক টাকা লাভ হত। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের খবরে ইতোমধ্যে ঢাকার এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছি তিনি সরাসরিসবজি নেবেন বলে কথা দিয়েছেন।

সদর উপজেলার খানপুর এলাকার গাউস মল্লিক ১০ বিঘা জমিতে বর্ষাকালীন বিভিন্ন সবজি চাষ করেন দুই দশক ধরে। তিনি বলেন, সিন্ডিকেটের কারণে উৎপাদিত সবজি কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হই আমরা। এখন পদ্মা সেতুর ফলে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে যাবে। তবে সিন্ডিকেট ও ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য কমাতে প্রশাসনের সহযোগিতাও প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

কচুয়া উপজেলার গজালিয়া এলাকার সবজি চাষি আব্দুর রহিম বলেন, শীতকালীন সবজির জন্য এ অঞ্চল প্রসিদ্ধ। আগে থেকে নদী পাড়ে দীর্ঘ সময় হওয়ার কারণে আমরা ঢাকার বাজারে সময়মত গিয়ে কৃষিপণ্য পৌঁছাতে পারতাম না। পথেই অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যেত। তাই স্থানীয় বাজারে বা ফড়িয়াদের কাছে কম দামে বিক্রি করতে হত। এখন সেতু দিয়ে সহজেই আমরা গাড়ি ভাড়া করে সবজি ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে পারব। এছাড়া ঢাকা থেকে ব্যবসায়ীরা বাগেরহাটে এসে সবজি কিনতে পারবেন।
জেলা কৃষিবিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাগেরহাটে কৃষক পরিবার রয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৩২৮টি। চলতি অর্থ বছরে জেলায় ধান উৎপাদন হয়েছে ৬ লাখ ৯০ হাজার ৭২০ মেট্রিক টন। সবজি উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাগেরহাটের উপ পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন কৃষকরা। বাগেরহাট থেকে বছরে অন্তত ৭০ হাজার মেট্রিক টন সবজি জাতীয় পণ্যঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় যায়। সেতুর ফলে কম খরচে, অল্প সময়ে এইকৃষিপণ্য পৌঁছে যাবে সর্বত্র। জেলার কৃষি বাণিজ্যিকরণে নতুন সম্ভাবনারদ্বার উন্মোচন হতে চলেছে।

এদিকে সরেজমিনে বাগেরহাট সদর উপজেলার কাড়াপাড়া, ডেমা, কাশিমপুর এলাকার একাধিক মৎস্য চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিংড়ি ও কার্প জাতীয় মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেল, টেংরা, পারসে, বেলে, তেলাপিয়া, পাতাড়ি) সহ উৎপাদিত মাছের বড় অংশের বাজার ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় স্থানীয় ফড়িয়া ও আড়তদারদের কাছে বিক্রি করে খুব একটা লাভবান হতে পারেন না প্রান্তিক চাষিরা।   

মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলায় ৬৬ হাজার ৭১৩ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৬৮৫টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। জেলায় চাষি রয়েছেন প্রায় ৫৬ হাজার। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে সাড়ে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে এই পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার মেট্রিক টন।

২০২১-২২ অর্থ বছরে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ হাজার মেট্রিক টনে। টাকারঅংকে বাজার মূল্য প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে সাদা মাছ উৎপাদন হয়েছে ৬০ হাজার মেট্রিক টন। টাকার অংকে মূল্য ১৪ হাজ়ার কোটি টাকা।
বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা এলাকার চাষি সাইদুল ইসলাম বলেন, ফেরির কারণে মাছ নিয়ে ঢাকায় যেতে দেরি হত ব্যবসায়ীদের। ফলে অনেক সময় মাছ নষ্ট হয়ে যেত, আবার স্বাভাবিকভাবে গেলেও মাছের রং নষ্ট হওয়ার কারণে দাম কম দিত ব্যবসায়ীরা। এখন আর এই ধরনের সমস্যা থাকবে না। আমরা ন্যায্যমূল্য পাব আমাদের উৎপাদিত পণ্যের।

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, বাগেরহাটেরস্থানীয় চাষিরা পুকুর-ঘের থেকে যে মাছ ফজরের সময় ধরবেন, সকাল ১০টার মধ্যে সেই মাছ পাওয়া যাবে ঢাকার বাজারে। এতে চাষি যেমন লাভবান হবেন, তেমনি রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে ভোক্তারা টাটকা মাছ পাবেন।
তিনি আরও বলেন, বাগেরহাটের মাছের বড় অংশের ক্রেতা রাজধানী ও শহরের মানুষ। এখন থেকে চাষিরা সহজেই মাছ ঢাকার বাজারে পাঠাতে পারলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য অনেকটাই কমে যাবে।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মধ্যে বাগেরহাট সবচেয়ে উন্নত হবে। অর্থনৈতিকভাবে এ জেলায় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হল। কৃষকরা যেমন ন্যায্যমূল্য পাবে, তেমনি তাজা এবং টাটকা কৃষিপণ্য সরবরাহ করা সম্ভবহবে দেশের অন্যত্র। পাশাপাশি পর্যটন ও বন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার বহুগুনে বৃদ্ধি পাবে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৬ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।