ঢাকা: কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে শ্রমিকদের পাওনা টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি কামরুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা থেকে গ্রামীণ টেলিকমের আগের এমডি ও বর্তমান এমডি ২৬ কোটি টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত।
ডিবি জানায়, লভ্যাংশ পাওনা পরিশোধ, অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার প্রলোভনের পাশাপাশি গ্রামীণ টেলিকম অফিস ক্যাম্পাসে কর্তৃপক্ষ মেসেজ ছড়িয়ে দেয় যে, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হবে’, এবং ক্ষমতার পট পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রী হবেন গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূস। তখন শ্রমিকদের এসব মামলা কোনো কাজে আসবে না, শ্রমিকরা কোনো ক্ষতিপূরণও পাবেন না; বিপরীতে তাদের চাকরি হারানো ও জেল খাটাসহ অন্যান্য নির্যাতনের মুখে পড়তে হবে।
এই ভয়ে এবং কিছুই না পাওয়ার অনিশ্চয়তার বিপরীতে টেলিকম কর্তৃপক্ষের ৪৩৭ কোটি টাকার প্রলোভনে আইনজীবীর পরামর্শে তারা দ্রুততার সঙ্গে অর্থ তুলে নেয়। টেলিকম ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও আইনজীবী একাধিকবার এই সমঝোতার বিষয়টি গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে বলেন।
বুধবার (৬ জুলাই) দুপুরে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ডিবি উত্তরের যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা পাওনা আদায় ও দাবি-দাওয়াসহ মোট ১৯০টি মামলা করেন। এসব মামলা তুলে নেওয়ার জন্য আইনজীবীর মাধ্যমে মোটা অংকের টাকার অফার দেয় টেলিকম কর্তৃপক্ষ। একটা পর্যায়ে মামলা তুলে নেবে, কোম্পানিকে দায়মুক্তি দেবে, নিজেরা চাকরি থেকে রিজাইন করবে এবং ইউনিয়ন বিলুপ্ত করবে, সেই বিনিময়ে শ্রমিকরা ৪৩৭ কোটি টাকা পাবে বলে চুক্তি হয় শ্রমিক ও গ্রামীণ টেলিকমের মধ্যে।
কিন্তু সেই টাকার বড় একটি অংশ নামে বেনামে আত্মসাৎ হয়েছে। টাকা আত্মসাতের অভিযোগে একজন সিবিএ নেতা মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেন৷ সেই মামলা তদন্ত করছে ডিবির গুলশান টিম।
গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষ এবং আইনজীবী ও টেলিকম সিবিএ নেতার যোগসাজশে তড়িঘড়ি করে শতাধিক মামলা থেকে গ্রামীণ টেলিকমকে ইনডেমনিটি দেওয়ার জন্য বিশ্বাসভঙ্গ, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় গ্রামীণ টেলিকম কর্মচারী ইউনিয়নের দুইজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
বাদী অভিযোগে উল্লেখ করেন, গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানিতে বিভিন্ন সময়ে নিয়োজিত শ্রমিক কর্মচারীদের স্থায়ীকরণ না করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ক্রমাগত নবায়ন করে। শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী বাৎসরিক লভ্যাংশের ৫ শতাংশ অর্থ (৮০:১০:১০) অনুপাতে ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ), শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড এবং শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন বরাবর দেওয়ার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির ‘কর্মচারীরা স্থায়ী নয়’ এবং ‘কোম্পানি অলাভজনক’ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের কথা বলে শ্রমিকদের আইনানুগ লভ্যাংশ দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
বিভিন্ন আইনানুগ দাবি-দাওয়ার কারণে ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর একযোগে বেআইনিভাবে ৯৯ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করে গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষ। শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ ও লভ্যাংশ পাওনা, বেআইনিভাবে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পরে কোম্পানিতে পুনর্বহাল, কোর্টের আদেশ অনুযায়ী পুনর্বহালের পরেও দায়িত্ব না দিলে কনটেম্পট অব কোর্ট (আদালত অবমাননা), কোম্পানির অবসায়ন দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে শ্রমিকরা এবং শ্রমিক ইউনিয়ন গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় শ্রম আদালত এবং হাইকোর্টে প্রায় ১৯০টি মামলা ও রিট পিটিশন দায়ের করেন।
তড়িঘড়ি করে অনেকটা গোপনে এ সব মামলা উত্তোলন, শ্রমিকদের অর্থ দেওয়া এবং প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়।
ডিবির কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ আরও বলেন, গ্রামীণ টেলিকম এবং গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী গত ১০ মে ঢাকা ব্যাংক গুলশান শাখায় একটি সেটেলমেন্ট একাউন্ট খোলা হয়। ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর কোম্পানির মোট লভ্যাংশের ৫ শতাংশ টাকা হারে কোম্পানি থেকে এই সেটেলমেন্ট একাউন্টে প্রায় ৪৩৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়। অ্যাকাউন্টটি থেকে অর্থ উত্তোলনের জন্য গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বাধ্যতামূলক সিগনেটরী এবং ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অন্য দুই সিগনেটরি হিসেবে রাখা হয়।
শ্রমিকদের সব পাওনাদি ওই অ্যাকাউন্ট থেকেই পরিচালিত হওয়ার কথা। চুক্তি অনুযায়ী সেটেলমেন্ট একাউন্ট থেকে শ্রমিকদের পাওনা এবং ৫ শতাংশ অগ্রীম কর ব্যতীত অন্য কোনো অর্থ ছাড় করার সুযোগ না থাকলেও বিধিবহির্ভূতভাবে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং ওই দুই সিবিএ কর্মচারীসহ ইউনিয়নের কিছু নেতার যোগসাজসে ওই অ্যাকাউন্টের আনুমানিক ৪৩৭ কোটি টাকা থেকে চেকের মাধ্যমে গত ১৭ মে এবং ২৫ মে ২৬ কোটি ২২ লাখ টাকা গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক ইউনিয়নের ডাচ বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে নিয়ে আসা হয়।
গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক ইউনিয়নের ওই অ্যাকাউন্টের মোট তিনজন সিগনেটরী ছিলেন গ্রেফতার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং মামলার বাদী অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান। অন্যান্য শ্রমিকদের মতো টাকা পাওয়ার পরেও যোগসাজশে সিবিএ সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান ও সহ-সভাপতি মাইনুল হাসান ইউনিয়নের অ্যাকাউন্ট থেকে মিরপুরে তাদের ডাচ বাংলা ব্যাংক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে তিন কোটি করে মোট ৯ কোটি টাকা স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করে।
ইউনিয়নের নিয়োজিত আইনজীবী অযৌক্তিক ও অতিরঞ্জিতভাবে প্রায় ১৬ কোটি টাকা ফি হাতিয়ে নেন বলেও জানান ডিবি উত্তরের যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪২ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০২২
পিএম/এসএ