আবারও তারেক রহমান। আবারও সেই মিথ্যার ‘গোয়েবলসীয়’ ঢাকের বাদ্য।
বিজয় দিবস উপলক্ষে সোমবার ইস্ট লন্ডনের অ্যাট্রিয়াম ব্যাংকোয়েট হলে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত সভায় তারেক যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘‘রাজাকার’’ বলে গালি দিলেন উপস্থিত নেতাকর্মীরা তখন সমস্বরে ‘‘রাজাকার’’ ‘‘রাজাকার’’ ধ্বনিতে হলঘর কাঁপিয়ে তোলেন। এমনটাই তো হয় যুগে যুগে! ফেউ আর চাটুকারদের কাজই তো সেটা। সাধে কি আর রবি ঠাকুর বলে গিয়েছেন, ‘‘রাজা যতো বলে / পারিষদ শতগুণ!’’
''তিন্তিরি গাছে জোনাকীর দল
চাঁদের নিন্দা করে কেবল। ’’
আর আমাদের জাতীয় কবি নজরুলও কম যান না। ছোট মানসিকতা আর নিম্নরুচিকে তিনি ধিক্কার জানিয়েছিলেন চাঁদ আর জোনাকির উপমা টেনে। গল্টা এমন: একবার এক বাচ্চা জোনাকি দেখলো যে তার পুচ্ছদেশে মিটি মিটি আলো জ্বলছে। সে আলোতে আত্মমুগ্ধ জোনাকির কাণ্ডজ্ঞান লুপ্ত হ’তে হ’তে এক পর্যায়ে তা বিকারের পর্যায়ে চলে যায়। নিজের পেছনে জ্বলতে থাকা মিটিমিটি আলোকেটাকেই জগতের একমাত্র রোশনাই ভাবতে থাকে সে। কিন্তু পরক্ষণেই সে দেখতে পায় জগৎ-চরাচর ব্যাপ্ত করে রয়েছে আকাশে কুলপ্লাবী চাঁদের আলো। তা দেখে জোনাকির আর ভালো লাগে না। ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মরতে থাকে সে। নিজেকে সে চাদেঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে। চাঁদকে সে ভাবতে থাকে পথের কাঁটা। তো একদিন সে মনস্থির করলো এখন থেকে সে চাদেঁর নিন্দা-বদনাম করবে। আর এভাবেই চাঁদের বারোটা বাজাবে। তখন লোকে আর ‘‘চাদেঁর নষ্ট আলো’’র দিকে তাকাবে না। তাকাবে কেবল তার পুচ্ছদেশের মিটিমিটি আলোর দিকে। কিন্তু দুনিয়া তো আর জোনাকির কথায় চলে না। দুনিয়া চলে নিজের বিবেকে। লোকে আজও তাই চাঁদের পানেই চায়; মুঠোমুঠো, জ্যোৎস্না মাখে, কাব্য করে, রোম্যান্টিক আবেগে ভাসে আর পায় নিজের নিজের মতো ক্ষণিকের স্বর্গসুখ। -চাঁদ আজো রয়ে গেছে সবার নয়নে, হৃদয়ে, কল্পনায়, স্বপ্নে অপার্থিব আলোর মাহফিল হয়ে। নজরুল তাই লিখে গেছেন:
''তিন্তিরি গাছে জোনাকীর দল/ চাঁদের নিন্দা করে কেবল। ’’
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তারেকের এই হঠকারি মন্তব্য বিএনপি নামের দলটির রাজনৈতিক সংস্কৃতির নিম্নমানকে এবং এর দেউলিয়াত্বকেই তুলে ধরে। আমরা একে মন্তব্য না বলে বলবো জনসমক্ষে দেওয়া গালি। এমন গালি তিনি ক্রমাগত দিয়েই চলেছেন আর আমরা তা শুনে শুনে আহত বোধ করেছি।
তারেকের সাম্প্রতিকতম মন্তব্য নামের গালিটি তার মনোবৈকল্যকেই তুলে ধরেছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার নিন্দাবাদ ও কটূক্তি তার মানসিক সুস্থতার লক্ষণ নয় মোটেই। বঙ্গবন্ধু নিয়ে তিনি ‘‘ওভার অবসেসড’’। তার এই ‘‘অত্যাসক্তি’’, বদ্ধমূল ঘৃণা ও মুজিববিদ্বেষ প্রকারান্তরে মনোবিকলনেরই নামান্তর। আঘাতপ্রাপ্ত মেরুদণ্ডের পাশাপাশি তার মনের চিকিৎসাও যে সমান জরুরি---- এখন একথা বলবার সময় এসেছে বলেই আমরা মনে করি। লন্ডনের মতো উন্নত শহরে সেটা দুর্লভও নয়। কেননা তিনি বিএনপির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি—এটা মাথায় রেখে তা বলাই যায়।
তারেকের এই মন্তব্যকে ব্যক্তি তারেকের বক্তব্য বলে মনে করবার কারণ নেই। কেননা বিএনপি নামের দলটির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তিনি। ফলে এই বক্তব্য বিএনপিরই।
অতীতের দিকে একটু চোখ ফেরালে আমরা দেখব ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাঁকিয়ে বসা সেনাতন্ত্র ও পাকিস্তানপন্থিদের শিরোমনি হিসেবে সবচে বড় বেনিফিশিয়ারি হচ্ছেন তারেকের পিতা জিয়াউর রহমান। জিয়া সামরিক শাসন কায়েম করে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অর্থকে নিয়ামকশক্তিরূপে প্রতিষ্ঠা দেন। ‘‘মানি ইজ নো প্রবলেম’’ ---জিয়া এই ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের বর্বর পশ্চাদপদ দেশগুলোর সরকারগুলোর কাছ থেকে পাওয়া অডেল পেট্রোডলারের বন্যা বইয়ে দিতে থাকেন। তিনিই বিভিন্ন স্বাধীনতাবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল এলিমেন্টকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনাকে ধ্বংস করতে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নামেন। তার হাত দিয়েই শুরু হয় স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া। প্রথমে জাগদল ও পরে বিএনপি গঠন করার মধ্য দিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির পথ সুগম করেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের পুরস্কৃত করেন। তিনিই পাকিস্তানি নাগরিক রাজাকারকূলশিরোমনি গোলাম আযমকে নির্বিঘ্নে স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখার অনুমতি দেন। পরে গোলাম আযম পেয়ে যায় নাগরিকত্ব। রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানান। এখানেই শেষ নয়, ইনডেনিটি অধ্যাদেশ জারি করে জিয়াউর রহমান সপরিবারে বঙ্গবন্ধুহত্যা ও জেলের ভেতরে জাতির সূর্যসন্তানদের হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেন। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে নির্বাসনে পাঠান জিয়া। তার সময়ে পাঠ্যপুস্তকে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটি মুছে দেওয়া হয়।
এভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একের পর এক বিষবৃক্ষের বীজ ছড়িয়ে গেছে বিএনপি। সর্বশেষ সংস্করণটি হচ্ছেন তারেক রহমান। সত্য, ন্যায়, শোভনতা, সৌজন্য ও কাণ্ডজ্ঞান নয়, বরং মিথ্যাই হয়ে উঠেছে তারেক ও তার দল বিএনপির শেষ আশ্রয়। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, তিনি জার্মানির নাৎসী নেতা এডলফ হের হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসকে গুরু মেনে এগোচ্ছেন। গোয়েবলস বলতেন, একটা মিথ্যাকে বারবার বললে এক সময় লোকে তা সত্য বলে জানবে। তারেকও সেটাই করছেন। কিন্তু ইতিহাসকে কিছুকাল মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় বটে, কিন্তু ইতিহাসকে মুছে ফেলা যায় না কখনো। ’৭৫ পরবর্তীকালে তারেকের পিতা ও তার পরবর্তী অনুসারিরাও সেটা পারেননি। ধামাচাপা দিয়ে রাখা ইতিহাস আজ এতোদিন পরও স্বমহিমায় ফিরে এসেছে। তথ্য-প্রযুক্তির প্রসার, গণমাধ্যমের সজাগ ও অনুসন্ধানী ভূমিকার কারণে ইতিহাস আবার কথা বলছে। চেপে রাখা-দমিয়ে রাখা ইতিহাস দলিল-দস্তাবেজ-ফুটেজ ও নানা প্রমাণাদিতে আবার কথা বলছে নতুন করে। এক তারেকের সাধ্য নেই ইতিহাসের অভিমুখকে ঘুরিয়ে দেবার। ইতিহাসে গোয়েবলসদের ভূমিকা নির্দিষ্ট---নায়ক এরা হতে চাইলেও ইতিহাসে ওরা চিরকালই খলনায়ক হয়েই আছে থাকবে।
মনগড়া বেফাঁস উক্তি দিয়ে যে হাততালি তিনি অ্যাট্রিয়াম ব্যাংকোয়েট হলে পেলেন তা বড়ই সাময়িক। যারা তার সামনে আজ হাত কচলান তারা তার দুর্দিনে কোথায় ছিলেন---এ প্রশ্ন তারেক নিজেকে হয়তো করবেন একদিন। ইতিহাস সম্বন্ধে একটা মহাজন উক্তি মনে পড়ে:‘‘ইতিহাস কল্পনা বা অধ্যাস নয়, উচ্ছ্বসিত আবেগ বা প্রশান্তির সমষ্টি নয়, ইতিহাস সত্যাশ্রয়ী। ’’
তারেক ও তার দল সত্য থেকে বিচ্যুৎ হ’তে হ’তে মিথ্যা ও অসত্যই এখন পাথেয় হয়ে গেছে তাদের। কিন্তু দশটি মিথ্যা একসাথে জোড়া দিলেও তা সত্য হয় না। যদি তা-ই হতো তাহলে সর্বকালের সেরা মিথ্যাবাদী গোয়েবলসই হতো নায়ক---একথা আমরা আগেই বলেছি। কিন্তু তার ঠাঁই হয়েছে ঘৃণার নরকে।
গালিপটুতা দিয়ে তারেক বঙ্গবন্ধুকে হেয় করতে চেয়ে নিজেকেই কেবল নামাচ্ছেন নিচে। নিজের ব্যক্তিত্বকে করে তুলেছেন হাস্যকর আর খেলো। পুচ্ছে মিটিমিটি আলো নিয়ে নিজেকে চাঁদের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে দাঁড় করাবার যে হাস্যকর প্রয়াস তিনি চালাচ্ছেন তা তার হতাশায়-নুয়ে-পড়া মনের অসহায়ত্বকেই তুলে ধরছে কেবল। তেঁতুল গাছ অব্দি আরোহণের অলীক গর্বে চৌচির তুচ্ছ জোনাকির মতোই তার অসহায়ত্ব বঙ্গবন্ধুকে গালি দেবার মধ্যে প্রকট হয়ে বাজে। গালিটা কে না দিতে জানে! কিন্তু গালি দেয় সে-ই কেবল, যার আর কিছু দেবার নেই। পথের ভিখিরিই সেটা সবচে ভালো দিতে জানে। তারেক দিনদিন গালিপটু হ’য়ে উঠছেন দেখে তার নিজের ও তার দল বিএনপির দেউলিয়াপনাই ঢোলের বাড়ি হয়ে বাজছে। আবারও তাকে শোনানো যাক নজরুলের অমোঘ-অমর দুটি পঙক্তি:
''তিন্তিরি গাছে জোনাকীর দল
চাঁদের নিন্দা করে কেবল। ’’
** তারেকের বিকৃত ইতিহাস : ‘ইয়াহিয়াকে মেনে নিয়েছিলেন শেখ মুজিব’
** ‘জিয়াই প্রথম রাষ্ট্রপতি, যুক্তিহীন বিতর্ক আ.লীগের’
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৪