ঘড়িতে সময় সকাল সাড়ে ছ’টা। অফিস যাবার তাড়ায় নির্ধারিত সময়েই ঘুম ভেঙে যায়।
রেলপথ ধরে বিরামহীন চলা ট্রেনের শব্দ সবুজ, নীরব প্রকৃতিকে মাঝে মাঝে সচকিত করে তোলে। কখন কখনও এক গন্তব্য থেকে আরেক গন্তব্যে ট্রেনের ছন্দায়িত ছুটে চলা ধ্বনি-মায়াজাল তৈরি করে। আবার কখনও দূরে কোথাও হারিয়ে যাবার হাতছানি দেয় চলমান ট্রেনগুলো।
বহুতল ভবন তো দূরের কথা, দ্বিতল কোনো ভবনের চিহ্নমাত্র নেই এই জানালার আশপাশে। আকাশছোঁয়া সুউচ্চ ভবনমুক্ত এই জানালার চারিধারের দীর্ঘ বিস্তৃত এই স্থানটুকু আমার খুব প্রিয়। জানালা থেকে সোজা তাকালে দেখা যায় নাক বরাবর প্রায় তিনটি এভিনিউ অতিক্রমকারী বাস, ট্রাক আর বিভিন্ন ধরনের গাড়ির চলাচল।
কিন্তু আজ সকালে বাইরের দৃশ্য যেন নতুন রূপে, নতুন সৌন্দর্যকে ধারণ করে দেখা দিল আমার সামনে। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে নেই। দমকা বাতাস নেই। ঝড়ো হাওয়ার এলোমেলো দাপাদাপি নেই। মুখ বেজার করে বসে নেই আকাশ। মুষলধারায় অথবা ঝির্ঝির্-বৃষ্টিতে সবুজ প্রকৃতি সিক্ত হচ্ছে না। তাহলে আজকের দৃশ্যটি কী, যা সত্যি আমায় আলোড়িত করেছে?
আজকের সকাল দেখে মনে হচ্ছে ধরিত্রী যেন ধূসর চাদর গায়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারিধার। আমার দেখা প্রতিদিনের সবুজ প্রকৃতি, রেলপথ, দিবারাত্র ছুটে চলা ট্রেন, রাস্তার গাড়ির বহর--- সবই যেন ধূসর চাদরের আড়ালে লুকিয়ে আছে। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কেবলই মনে হচ্ছিল, আমার চোখে বোধ হয় চশমা নেই। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এত ঘন কুয়াশা যে চারপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।
কুয়াশার ঘনত্ব সব কিছুকে দৃষ্টির আড়ালে ঠেলে দিয়েছে।
ঘুম ভাঙা চোখে মেঘলা আকাশ দেখলে মন বিষণ্ন ও বেদনার্ত হয়ে ওঠে। বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়াও তেমনি মনের গহীনে ব্যথা জাগায়। অথচ কুয়াশাচ্ছন্ন ধূসর প্রকৃতি দেখে এমন এক অনুভূতি আমাকে পেয়ে বসে মনে হয় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কুয়াশার এই রূপ আমি শুধুই দু’চোখ মেলে দেখি।
কিন্তু দ্রুতবেগে ধেয়ে চলা ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে পথ চলা মানুষের পক্ষে কি প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ সম্ভব? বিশেষ করে বিশ্বের রাজধানী খ্যাত ব্যস্ত শহর নিউইয়র্কবাসীর পক্ষে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ঝটপট তৈরি হয়ে নেমে এলাম রাস্তায়। কিন্তু কুয়াশা আমার পিছু ছাড়ছে না। কুয়াশার পথ কেটেই আমার সাবওয়ের দিকে হেঁটে চলা।
ট্রেনে চেপে বসতেই আমার দু’চোখ চলে যায় বাইরে, কুয়াশার ঘনত্বকে সজোরে সরিয়ে সূর্যের উপস্থিতি ঘোষণার জোর লড়াইয়ের প্রতি আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। সকালের মিষ্টি রোদের আদর মাখা তাপটুকু ছড়িয়ে দিতে চাইছে সূর্য শহরবাসীর গায়ে। নিজেকে প্রকাশের এ এক নিরন্তর প্রয়াস। সূর্য মনে হয় প্রাণপণ লড়াই করে চলেছে কুয়াশা’র আবরণ ভেদ করে নিজেকে জানান দিতে। নিজের শক্তিমত্তাকে ধরণীমাঝে তুলে ধরতে। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। মজাই লাগছিল সূর্যের করুণ দশা দেখে।
আমার গন্তব্য কুইন্সের ফ্লাশিং। পথের দূরত্ব কম নয়। ট্রেনে যেতে যেতে কুয়াশার নিবিড় বন্ধনে আবিষ্ট সবুজ প্রকৃতিকে খুঁজে ফিরে পেতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। প্রকৃতিও যেন কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে ধূসর রূপে নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে।
গত প্রায় ২০ বছরে নিউইয়র্কে আমার এত ঘন কুয়াশা দেখার এটাই প্রথম অভিজ্ঞতা। কুয়াশার ছাই মাখা রংয়ের গভীর মায়ায় আমিও আচ্ছন্ন। মনে হচ্ছিল কুয়াশার সৃষ্ট এই রহস্যের জাল কোনোভাবেই ছিন্ন হবার নয়। আমার ভাবনার জগৎ অকারণে চঞ্চল এলোমেলো। সেখানেও চলছে রহস্যের এক লুকোচুরি খেলা।
কখন যে মন ফিরে চলে মাটির টানে। হেমন্ত আর শীতকাল আমায় পিছু টানে। হাতছানি দেয়। হেমন্তের সকালের কুয়াশা আর শীতের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের ছবি যেন দেখতে পাই চোখের সামনে। ভারী হয়ে আসে মন। মনে পড়ে যায় কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে বাংলার পল্লীর পথ-প্রান্তর। ধানের শীষের ডগায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু শিশির। আর এই শিশিরভেজা ঘাস মাড়িয়ে পথ চলা। হেমন্তের নবান্ন উৎসবে পিঠা-পায়েসে মেতে থাকা। শীতের সকালে কাঁথা জড়িয়ে গুটিসুটি বসে থাকা খেটে খাওয়া মানুষের কথা। ছেঁড়া কাঁথার ফাঁক ফোকর গলিয়ে হাড় কাঁপানো শীতের অনুপ্রবেশ থেকে রেহাই পেতে আগুন জ্বেলে চারিধার ঘিরে থাকা মানুষগুলো আমার সমগ্র চেতনাতে ভর করে।
মনে পড়ে খেজুরের রস জ্বাল দেয়ার প্রাণ মাতানো গন্ধে বিভোর হওয়ার কথা। পিঠা তৈরির আয়োজন নিয়ে উনুনের পাশে বসে থাকা গ্রামবাংলার নিত্য দেখা অতি সাধারণ সেই মহিলার কর্মব্যস্ততার ছবি যেন জীবন্ত হয়ে উঠে আসে আমার সামনে। এ যেন এক মুভি দেখা। একের পর এক দৃশ্য যেন আমার অনুভবে সাড়া জাগায়। আমার সমগ্র অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় ফেলে আসা আমারই জন্মভূমিতে।
এক সময় ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছে, শুরু হয় হেঁটে পথ চলা। নজরে পড়ে ভারী কোট, জ্যাকেট, জুতা মাফলার আর টুপিতে আবৃত চারপাশের মানুষগুলোকে; শীত যাদের কাবু করে না। ঠাণ্ডার সাথে যাদের ঠাণ্ডার লড়াইয়ে লিপ্ত হতে হয় না। পাশাপাশি দৃশ্যমান হয় ছেঁড়া কাঁথা জড়ানো মানুষের মুখছবি। নিজেকে বড় স্বার্থপর ও সুবিধাভোগী চরিত্রের একজন বলে মনে হয়। দেশের মাটি ও মানুষ থেকে শুধু শারীরিক-ই নয় মানসিকভাবেও বোধ হয় আমি অনেক দূরে সরে গেছি। দূরত্ব বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেছে। আমার অনুভবে লজ্জা ও কষ্ট দু’টো একসাথে হাত ধরাধরি করে পাশাপশি দাঁড়ায়।
কুয়াশার ধূসর চাদরে আবৃত আজকের সকাল আমাকে যেমন এক নান্দনিক সৌন্দর্যের উৎসমুখের সন্ধান দেয়; অন্যদিকে কর্মব্যস্ততার অজুহাতে উত্থাপিত আমার বাস্তবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৪