এক.
শ্যালা নদীতে ট্যাংকার ডুবির প্রায় দশ দিন পর সুন্দরবনে যাওয়ার সুযোগ হল। তেল দূষণের পর সুন্দরবনের পরিস্থিতি নিয়ে বহুপাক্ষিক মত আর যুক্তির ভেতরে পড়ে একটা গোলক ধাঁধার ভেতরেও ছিলাম।
আমি খুব সামান্য একজন সাংবাদিক। সব বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ‘সেলিব্রেটি জার্নালিস্ট’ নই। পরিবেশ কিংবা বন্য জীবনযাপন সম্পর্কে আমার জ্ঞানের পরিধিও ততটা বিস্তৃত নয়। তবে পেশাগত দায়িত্বের প্রয়োজনে বড় বড় অনেক বিপর্যয়ের খবর এক যুগেরও বেশী সময় ধরে সরেজমিনে সংগ্রহ করছি। এ কারণে প্রত্যেক ঘটনার ধরন ও চরিত্র আলাদা হলেও সাধারণ কিছু প্রশ্ন একইভাবে উঠে আসে। কারণ সব বিপর্যয়ের পেছনে থাকে দীর্ঘদিনের দায়িত্বহীনতা, অনিয়ম, অবহেলা কিংবা দুর্নীতি।
কোন বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটলে পেছেনের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। খুঁজে না পেলে খুব অস্থির লাগে। খুব কম সময় হাতে নিয়ে সুন্দরবনে গেলেও শ্যালা এবং পশুর নদীর তীর বেয়ে সুন্দরবন এলাকা ঘুরে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। বনের এক কর্মকর্তার কথায় প্রাথমিক উত্তরটা পেয়ে গিয়েছিলাম। অনেক বড় বিপদ হতে পারত এই দুর্ঘটনায়, হয়নি। কারণ প্রকৃতি সুন্দরবন এবং বাংলাদেশের সহায় ছিল।
দুই.
ট্যাংকার ডুবির ঘটনার পর ঢাকা থেকে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের একাধিক সাংবাদিক গেছেন। অনেকে দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ ও প্রতিবেশ নিয়ে রিপোর্ট করছেন। অনেকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। শুরু থেকেই তাদের রিপোর্টে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের উপর তেল দূষণের প্রভাব নিয়ে গভীর অনুসন্ধান ছিল। নিজেরা সরেজমিনে যেমন ঘুরে দেখেছেন, তেমনি গবেষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সুন্দরবন এলাকায় দায়িত্বপালনকরা বন বিভাগের কর্মকর্তা, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে আমার ভেতরে শুরু থেকেই একটা প্রশ্ন ছিল, এতদিন ধরে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বিপদজনকভাবে পণ্যবাহী জাহাজ চলছে কিভাবে? কারা অনুমতি দিল, কেন দিল, তাদের কি ধারণা ছিল- এ ধরনের একটা দুর্ঘটনা বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে সামনে চলে এল মংলা-ঘষিয়াখালী খাল বন্ধ হওয়ার ইতিহাস। এটিই ছিল মংলা থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী নৌরুট। এই খাল দিনে দিনে ধ্বংস করা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ ছিল, প্রশাসন ছিল, সরকার ছিল, সবার সামনে এই খাল চিংড়ি ঘের মালিকদের প্রবল অত্যাচারে গভীর কোমায় চলে গেছে। এই বিষয়টা নিয়েই ঘটনার তিন দিনের মধ্যে একটা রিপোর্ট করলাম। সমকালে লিড রিপোর্ট হল। তার দুই/তিন দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘষিয়াখালী খাল উদ্ধার এবং চিংড়ি ঘের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু পেছনে অনেক বড় একটা অপশক্তি পার পেয়ে গেল। যে সব কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতায়, যেসব কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে ঘষিয়াখালী খাল ধ্বংস হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কিছুই বললেন না।
নদী পথের নাব্যতা চালু রাখার দায়িত্ব নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং আভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের। ঘষিয়াখালী খাল হারিয়ে যাওয়ার প্রধান দায় তাদের। যে চিংড়ি মালিকরা ক্রমাগত খালের প্রবাহ বন্ধ করে ঘের নির্মাণ করেছেন, দায় তাদেরও। উচিত ছিল দায়ীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে ঘষিয়াখালী খাল উদ্ধারের ব্যয় নির্বাহ করা। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা ছিল না, কারণ এখনও পর্যন্ত আমলাতন্ত্রই সরকারের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী, এ কারণে দুর্নীতির দায়ে কখনও কখনও রাজনীতিবিদদেরও বিচার হতে পারে, কিন্তু দুর্নীতিবাজ আমলারা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। বন বিভাগ বার বার এই খাল বন্ধ হওয়ার বিপদ এবং শ্যালা নদী দিয়ে নৌকা চলাচলের ঝুঁকি সম্পর্কে চিঠি লিখেছে, এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এই চিঠি লেখাই যথেষ্ট নয়, তাদের আরও বেশী সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল। তবুও দু’চার খানা চিঠি চালাচালি করে জাতিকে ধন্য করার জন্য বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে।
বন বিভাগের এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলাম, ঘষিয়াখালি খালের প্রবাহ মুখ থেকে কি চিংড়ি ঘের মালিকদের সরানো সম্ভব হবে! কর্মকর্তা জবাব দিলেন, অবশ্যই। প্রয়োজনে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। চমকে উঠলাম। সরকারি খাস জমি দখল করে আর্ন্তজাতিক নৌ-রুটের প্রবাহমান খাল বন্ধ করে যারা চিংড়ি ঘের তৈরি করল তাদের কাছ থেকে বরং ক্ষতিপূরণ আদায় করা উচিত, এখন উল্টো তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে? সত্যিই বিচিত্র এই দেশ! অনেকে যুক্তি দেন, চিংড়ি রপ্তানি থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার আয় বন্ধ করে দেওয়া হবে? একই যুক্তিকে চিংড়ি ঘেরের কবলে পড়ে চকরিয়া সুন্দরবন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন জরুরী প্রশ্ন হচ্ছে, প্রবাসী কর্মীদের ঘামে-শ্রমে বছরে তেত্রিশ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স আয়ের দেশে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার চিংড়ি রপ্তানির জন্য কি চকরিয়া-সুন্দরবনের মতই বিশ্বের ‘বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’ সুন্দরবনকেও তিলে তিলে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে..?
তিন.
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, শ্যালা নদীতে যে ট্যাংকার ডুবেছিল সেটার ফিটনেস ছিল কি’না। উত্তর হচ্ছে না। একটা সাধারণ কার্গো ট্রলার কে অবৈধভাবে তেলের ট্যাংকার বানানো হয়েছে, এটি প্রকৃত ট্যাংকার ছিল না। এই কার্গোকে তেলের ট্যাংকার হিসেবে চালানোর অনুমতি দিল কোন কর্তৃপক্ষ? এখানেও দায় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, আভ্যন্তরীণ নৌযান চলাচল কর্তৃপক্ষ, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর এবং মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের। রাস্তায় যেমন ফিটনেসবিহীন গাড়ি, নদীতেও তেমনি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহায়তায় দিব্যি চলছে ফিটনেস ছাড়া নৌযান। যার বড় প্রমাণ ডুবে যাওয়া সাউদার্ন স্টার-৭।
অনুসন্ধানে জানা গেল, এই সাউদার্ন স্টার নির্মিত হয় ১৯৯৮ সালে। মানিকগঞ্জের শিল্পপতি আব্দুর রহিম খান এই জাহাজ নির্মাণ করেন বালু ও পাথর টানার উপযোগী করে। তখন এর নাম ছিল ‘আল মামুন। ’ দুই বছর পর এর নাম হয় ‘ওটি আল মামুন’ এবং বৈধ অনুমোদন ছাড়াই এটিকে তেলের ট্যাংকারে রূপান্তর করে তেল পরিবহন শুরু হয়। ২০০৩ সালে প্রায় চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়লে নৌযানটি বিক্রি করে দেন আব্দুর রহিম খান। কিনে নেন ভোলার একজন অমিত প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীর ক্ষমতাধর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। কিনে নেওয়ার পর নতুন মালিক আমীর হোসেন এর নাম দেন ‘সাউদার্ন স্টার-৭’।
ক্ষমতাধর মালিক বলেই হয়ত, শ্যালা নদীতে এটি ডুবে যাওয়ার পর বিআইডব্লিউটিএ সাহসই পায়নি এই জাহাজে হাত দেওয়ার। জাহাজের মালিকের ঘুমও ভেঙ্গেছে ৪৮ ঘণ্টা পর! বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সুন্দরবনে ঘুরতে ঘুরতে এই প্রশ্নটি বিস্ময়ের সঙ্গে করছিলেন আলাপচারিতার ফাঁকে।
তিনি বললেন, একটা বিষয় মাথায় ঢুকছে না, এতবড় দুর্ঘটনার পর জাহাজের মালিক এলেন ৪৮ ঘণ্টা পর এবং তিনি বিনা বাধায় জাহাজ নিয়ে চলে গেলেন!
এই প্রশ্নটি আমার মনেও ঘুরপাক খেয়ছে। কারণ ঘটনার প্রথম দিনেই পরিষ্কার হয়ে গেছে সাউদার্ন স্টার-৭ বৈধ তেলের ট্যাংকার ছিল না। তাহলে কেন এর মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হল না? দায়িত্বশীল সরকার আছে, এমন কোন দেশ হলে দুর্ঘটনার পর প্রাথমিক হিসেবে ক্ষতির কয়েক গুণ টাকা জাহাজের মালিকের কাছ থেকে আদায় করা হত।
এমনিতেই বাংলাদেশ টাকাওয়লাদের জন্য সাত খুন মাফের দেশ, তার উপর মালিক হচ্ছেন সরকারি দলের নেতার ঘনিষ্ঠজন। অতএব তাকে নিয়ে একেবারেই টু শব্দ হল না। ফিটনেসবিহীন ট্যাংকার কিভাবে চলল, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর কিভাবে তাদের চলাচলের অনুমোদন দিল, কত টন পণ্য পরিবহনের ক্ষমতা ছিল, কত টন পরিবহন করা হয়েছে, তারও তদন্ত হল না? একই ভাবে প্রশ্ন ওঠে ওটি টোটাল নামে যে জাহাজটি সাউদার্ন স্টার-৭ কে ধাক্কা দিয়েছিল, তার সার্টিফিকেট ছিল কি’না!যত দূর জানতে পেরেছি ওটি টোটালের মালিকও বর্তমান সংসদের একজন এমপি। তার বাড়ি নরসিংদী জেলায়। কে জানে হয়ত ঘুষের টাকায় কাগজে কলমে ফিটনেস ঠিকই মালিকরা পেয়ে যান, এর জন্য জাহাজ ‘ফিট’ না হলেও চলে! গোমর যেন ফাঁস না হয়ে যায়, সে কারণে ওটি টোটালের চালকসহ চার কর্মচারী গ্রেফতারের মধ্য দিয়েই জাহাজ সংক্রান্ত সব তদন্তের মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে!
চার.
সুন্দবনে তেল দূষণ ছড়িয়ে পড়ার পর সবচেয়ে বেশী আলোচিত হয়েছে সুন্দরবনের অস্তিত্বের ঝুঁকি নিয়ে। বন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা এবং ওই এলাকার অধিবাসীদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা এক বাক্যে একটা কথা বলেছেন, জাহাজ ডুবির সময় মরা কাটাল চলছিল, অর্থাৎ সময়টা ছিল শুক্লপক্ষ থেকে কৃষ্ণপক্ষের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অর্ন্তবর্তী সময়। এ সময়ে চাঁদের আকর্ষণ কম থাকায় জোয়ারের দাপট ছিল কম। এ কারণে ভরা কাটালের মত প্রবল জোয়ারে পানি উপচে বনের ভেতরে দীর্ঘ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েনি। প্রকৃতির এই নিয়মই বড় বিপদের হাত থেকে এবার বাঁচিয়ে দিয়েছে সুন্দরবনকে। ভরা কাটালে জাহাজ ডুবলে বনের ভেতরে এত বেশী এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ত যে প্রাণীকূল রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ত।
বন কর্মকর্তাদের বক্তব্য হচ্ছে, সুন্দরবনে উদ্ভিদের অভিযোজন ক্ষমতা প্রবল। সাময়িক বিপদ কাটিয়ে ওঠার জন্য ম্যানগ্রোভের রয়েছে একাধিক অভিযোজন পদ্ধতি। কিন্তু প্রাণীকূল পুরোপুরি নির্দিষ্ট খাদ্যচক্রের উপর নির্ভরশীল। একবার খাদ্যচক্র ধ্বংস হলে সর্বনাশের চূড়ান্ত হতে খুব বেশী সময় লাগবে না। তেলের কারণে সেই খাদ্যচক্র ধ্বংস হওয়ার ঝুঁকি এখনও রয়ে গেছে।
তবে নদীর তীর থেকে বনের ভেতরে খুব বেশী এলাকায় তেল ছড়িয়ে না পড়ার কারণে ঝুঁকিটা এবার তত বড় করে দেখা হচ্ছে না। তারপরও দু’টো ভোদরের মৃত্যু, ওসপ্রে, কাইট জাতীয় পাখির নির্জীব হয়ে পড়া তারা গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন। একটা ইরাবতী ডলফিনের মৃত্যুর কথাও আলাপচারিতায় স্বীকার করলেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে তাদের জোর দাবি হচ্ছে, এই ডলফিনের মৃত্যু তেলের কারণে হয়নি। হয় জালে পেঁচিয়ে, নয়ত বুড়ো হয়েই মৃত্যু হয়েছে ডলফিনের। তার শরীরে তেলের আবরণ ছিল না, বরং লালচে রঙ প্রমাণ করে এটা জাহাজ ডুবির আগেই মারা গেছে। কিন্তু বেচারার মৃতদেহটি পাওয়া যায় জাহাজ ডুবির রাতেই। এ কারণে তখন সেটা বেমালুম চেপে রাখা হয়, কারণ তখন এই মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে তেলের কারণে মৃত্যু হয়নি, এটা কাউকে বিশ্বাস করানো যেত না। কি অদ্ভুত! সত্য লুকিয়ে রাখার কারণে এই ডলফিনের মৃত্যু নিয়ে যে তীব্র সন্দেহ আর বিতর্কের সৃষ্টি হল, তার থেকে কি খুব বেশী দায়মুক্তি পেলেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা? বরং সত্য যুক্তিসঙ্গতভাবে তুলে ধরলে প্রথমেই বিতর্ক এড়ানো যেত।
বিতর্ক যাই থাকুক, বিপর্যয়ের পর বন বিভাগের কর্মকর্তারা সুন্দরবন রক্ষায় যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়েই কাজ করছেন, এটা ঘুরতে ঘুরতে বোঝা গেছে। কর্মকর্তারা একটা বিষয়ের প্রতি বার বার জোর দিয়েছেন, এই পথ দিয়ে বিপদজনকভাবে নৌযান চলাচলের ঝুঁকি আর নেওয়া যাবে না। কারণ যদি আবারও এ ধরনের ঘটনা ঘটে এবং তখন যদি ভরা কাটাল থাকে, তখন বিপদ অনেক বড় হয়ে দেখা দেবে। অতএব বিপদে পড়ার আগে সতর্ক হওয়া খুব জরুরি। আর নিয়মিত তীব্র শব্দ আর বড় ঢেউ তুলে জাহাজ চললে নীদর তীর ভেঙ্গে গাছের জীবন যেমন বিপন্ন হয়, তেমনি প্রাণীকূল ভীত হয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে, নিয়মিত খাদ্য সংগ্রহেও ব্যাঘাত ঘটে।
বন কর্মকর্তাদের মতে, তেল দূষণের চেয়ে জাহাজের নিয়মিত শব্দ দূষণ বণ্য প্রাণীর জন্য আরও অনেক বেশী ক্ষতিকর। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দল এখন তদন্ত করছেন। তারা হয়ত এ বিষয়গুলো নিয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরবেন।
পাঁচ.
মাননীয় নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাহাজাহান খান দু:সময়ে খুব ভাল ভাল তত্ত্ব হাজির করেন! সেই তত্ত্বে অনেক সেলিব্রেটি সাংবাদিকও বিভ্রান্ত হন। যেমন গরু-ছাগল চেনার বিদ্যাকে চালক হওয়ার প্রধান শর্ত বলে তত্ত্ব দিয়েছিলেন। এবারও তিনি রাসায়নিক ছিটিয়ে তেল দূষণ দূর করার তত্ত্ব দুই তিন ধরে দিয়ে গেলেন। এবারও কেউ কেউ ঘটনার চার-পাঁচ দিন পর গণ্ডায় গণ্ডায় বাঘ-হরিণের মৃত্যুর খবর আর ছবি তোলার বিপুল আগ্রহ নিয়ে সুন্দরবনে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে এসে শাহাজান খানের কণ্ঠে সুর মিলিয়ে বলেছেন, কোথায় কিছুই তো হয়নি! এমনকি আশংকার কথা তুলে ধরে যারা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন, সেই সাংবাদিকদেরও অযাচিত আক্রমণ করে বসেছেন। বিষয়টা এমন, সুন্দরবনে ঘুরতে গিয়ে কোন সেলিব্রেটি সাংবাদিকের চোখে বাঘ না পড়লে তিনি সিদ্ধান্ত দেবেন, সুন্দরবনে বাঘ নেই এবং যারা বাঘ আছে বলে আগেই অনুসন্ধান করেছেন তাদের ভৎর্সনা করবেন!
বাস্তবতা হচ্ছে শাহজান খানের তত্ত্ব অনুযায়ী রাসায়নিক ছিটানো হলে সুন্দরবন আরও বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়ত। বন কর্মকর্তারা সময়োচিত সিদ্ধান্ত দিয়ে এ যাত্রায় সুন্দরবনকে রক্ষা করেছেন। আর্ন্তজাতিক বিশেষজ্ঞরাও কোন ধরনের রাসায়নিক না ছিটানোর জন্য মত দিয়েছেন। কারণ এই রাসয়নিক নদীর পানি, বনের গাছ এবং প্রাণীর শরীরে বিষক্রিয়া তৈরি করত, যার পরিণাম হত তেল দূষণের চেয়েও ভয়াবহ। আর এই রাসায়নিক তেলকে নদীর পানির নীচের স্তরে নিয়ে যেত, পুরোপুরি দূর করত না। পরিণামে কিছুদিনের মধ্যেই বিষক্রিয়ায় মাছ, ডলফিন মরে ভেসে উঠত।
সর্বশেষ চেষ্টা চলছে শ্যালা নদী দিয়ে আবারও পুরোদমে জাহাজ চলাচল শুরু করার জন্য। মংলা বন্দরে আটকে পড়া জাহাজের সংখ্যা যত বাড়ছে, তত এই দাবি প্রবল হচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং জাহাজ মালিকদের। এমনিতেও নিষেধাজ্ঞার ভেতরেও কর্তৃপক্ষের উদার দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে কিছু কিছু জাহাজ নির্বিবাদেই চলছে। হয়ত এ লেখা প্রকাশের আগেই সাময়িকভাবে পুরোদমে জাহাজ চলার ঘোষণা আসবে। নতুন বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষার শুরু হবে! ঘষিয়াখালী খাল নতুন করে চালুর বিষয়টিও চাপা পড়ে যাবে, বরং চিংড়ি ঘেরের সংখ্যা আরও বাড়বে!
প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ঘষিয়াখালী খালের মত শ্যালা নদীও না থাকত তাহলে মংলা বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনের কি হত? মংলা বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হত? একটা বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনের বিকল্প কোন রুট থাকবে না, একটা মাত্র নদীর উপর নির্ভরশীল থাকতে হবে, এটা কোন ধরনের যুক্তি? মংলা থেকে যদি সড়ক পথে দেশের সব জেলায় যাওয়া যায়, তাহলে সড়ক পথে পণ্য পরিবহনের বিকল্প ব্যবস্থাও থাকতে হবে। ভাল সড়কপথ না থাকলে সে ধরনের সড়ক পথ নির্মাণ করতে হবে। না হলে মংলা বন্দর অচল হওয়ার আশংকা যে কোন সময় তৈরি হবে।
সুন্দরবনের খুব কাছে রামপালে কয়লা নির্ভর তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কুশীলবরা নিশ্চয় এ বিপর্যয়ে কিছুটা ভয় পেয়েছেন। বড় দানের মওকা আবার ভেস্তে না যায়! তবে মনে হয় না তাদের ভয় পাওয়ার কিছু আছে। ‘সুন্দরবনের যা হয় হোক, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবেই’-মনে হয় না এই নীতির কোন পরিবর্তণ হবে! বরং কয়লাবাহী কোন জাহাজ ডুবলে কিংবা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত ১৪২টন বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইডের কারণে বড় কোন বিপর্যয় ঘটলে ঘটনা সামাল দেওয়ার জন্য কি ধরনের যুক্তি খাড়া করতে হবে, মন্ত্রী শাহাজান খানের কাছ থেতে নিশ্চয়ই তার পূর্বপাঠ খুব ভাল করে নিয়েছেন রামপালের উদ্যোক্তারা!
রাশেদ মেহেদী: বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক সমকাল
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৪