পেশোয়ার স্কুল ট্রাজেডির পুরো ঘটনা যেভাবে সামনে এসেছে, খুবই সামান্য যেটুকু দেখানো হয়েছে তার চেয়েও এ ঘটনা নিয়ে বিভাজন অনেক বেশি। ভয়ঙ্কর এ গণহত্যার ব্যাপারে যে ঐক্যমত দেখা যায় সে তুলনায় যারা এ জঘন্য অপরাধের জন্য দায়ী তাদেরকে কিভাবে মোকাবেলা করা হবে তা নিয়ে এখনো কোনো ধরনের পরিষ্কার জাতীয় বয়ান দেখা যায় না।
এ ঘ্টনা ১৩০ এরও বেশি স্কুলশিশুর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এখন এই ঘটনাই সরকারের জন্য অখণ্ড কাউন্টারটেররিজমের কৌশল ঠিক করার প্রয়োজনীয়তা জাগিয়ে তুলছে। এমনকি বহুদলীয় একটি কমিটির কাছে এর কৌশল নির্ধারণের ইস্যুটি যে স্বাক্ষরিত হয়ে আছে তা নিয়ে কাজ করার জরুরতও পড়ে গেছে। অথচ এত বড় মাত্রার এ ট্রাজেডিও প্রধানমন্ত্রীর নিষ্ক্রিয়তাকে নাড়া দিতে পুরাপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
ধারণা করা হয়, কাউন্টারটেররিজম পলিসি ইস্যুটি দীর্ঘদিন ধরেই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। অথচ বেশ কয়েকটি বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও এ পলিসি কোনো বাস্তব রূপ নেয় নাই। এসব ঘটনায় হাজার হাজার প্রাণ ঝরে গেছে। এতো কিছুর পরও এখনও নিশ্চিতভাবে এতোটা আশা করা যায় না যে, এই কমিটি ব্যাপকভিত্তিক কোনো কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাচ্ছে। জঙ্গিবাদ ও সহিংস চরমপন্থার অর্থ ও সংজ্ঞা নিয়েও এই বহুদলীয় কমিটিতে বহুবিধ মতপার্থক্য রয়েছে।
অবশ্য সর্বশেষ এটা শুনে ভালো লাগলো যে, সরকার ‘ভালো তালেবান’ ও ‘খারাপ তালেবান’ এর মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না। যদিও সবমিলিয়ে তালেবানের যে সংজ্ঞা ও বয়ান তৈরি হয়েছে তার মধ্যেই এসব লোক দেখানো ভাষা হারায়ে গেছে। কিন্তু যেসব চরমপন্থী ও জিহাদি গ্রুপগুলো ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’ এই দুই ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ে না তাদের ব্যাপারে কি হবে?
এই রহস্যময়তা ও অস্বচ্ছতা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দেশকে নিয়ে গেছে জঙ্গিবাদের আবাদভূমিতে। মাত্র কয়েকমাস আগে সরকার তালেবানের যে গ্রুপটির সাথে শান্তি আলোচনায় গেছে ঠিক এই গ্রুপটিই পেশোয়ারের স্কুলশিশু হত্যার দায় স্বীকার করেছে। একইসঙ্গে অন্যান্য বড় বড় সন্ত্রাসী হামলাগুলোরও দাবি করেছে।
পেশোয়ারের হত্যাকাণ্ডকে পাকিস্তানের জন্য নাইন ইলেভেনের ঘটনা হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো সাড়াশব্দ নেই। জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শ একটা ব্যাপার যেমন আছে কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্বহীনতাও আছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, কিভাবে এই কমিটি—যেখানে ভিন্নমতের রাজনৈতিক দল রয়েছে—সাতদিনের মধ্যে কাউন্টারটেররিজম পলিসি গঠন করতে পারে? অথচ সরকারও যেখানে এটি এক বছর কিংবা ছয়মাসেও করতে পারতো না।
মানে সরকার যখন কাউন্টারটেররিজম পলিসি গঠনের কাজটি এই বহুদলীয় কমিটির কাছে ‘আউটসোর্স’ করতে দিয়েছে তখন দেশের সেনাবাহিনী মনে হয় এ নিয়ে ইতিমধ্যে একটি কর্মপরিকল্পনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। গত সপ্তাহে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের মিটিংয়ে যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে দেখা যায়, শরিফ শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, বরং সেনাপ্রধানও বটেন। আসলে তিনিই হলেন সেনাবাহিনীর মূল কর্ণধার।
আসলে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যুতে প্রধান ভূমিকা রাখছে সেনাবাহিনীই। অথচ মৌলিকভাবেই এই দায়িত্ব নির্বাচিত নাগরিক নেতৃত্বের। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই এর নেতৃত্ব দেবেন এবং সবধরনের কর্মপরিকল্পনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু এখানে সুনিশ্চিতভাবেই এটি হচ্ছে না। মোটকথা নির্বাচিত এ সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় এসব উদ্যোগ এখন সেনা সদরসদপ্তরের কাছে চলে গেছে।
আমরা যতদূর দেখেছি, সাধারণত পাকিস্তান সেনাবাহিনী আকাশ ও স্থলপথে হামলা চালিয়ে গত সপ্তাহে প্রায় পঞ্চাশজন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে হত্যা করেছে। সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো পেশোয়ারের হত্যাকাণ্ডের কয়েকঘণ্টার মধ্যে সেনাবাহিনীর ভূমিকা। মানে সরকার পেশোয়ারের ঘটনার কয়েকঘণ্টা পরই ফাঁসির স্থগিতাদেশ তুলে নেয়। এবং বেশ কয়েকজন জঙ্গিকে ফাঁসি দেয়।
অনেক কারণেই সেনাবাহিনীর এসব হামলা বর্তমান পরিস্থিতিতে ন্যায়সঙ্গত হতে পারে। কিন্তু এসব হামলা কোনোভাবেই কাউন্টারটেররিজম পলিসির বিকল্প হতে পারে না। এসব হামলা প্রতিশোধ আকারে নেয়া হয়েছে। যা আসলে পক্ষান্তরে জঙ্গিবাদ ও সহিংস চরমপন্থার কারণ নির্মূলের জরুরি নীতি গ্রহণ থেকে মনোযোগই সরিয়ে নিচ্ছে।
সন্ত্রাস অবশ্যই সন্ত্রাসবাদে শেষ হয়ে যায় না। শুধু ফাঁসি দিয়েই সন্ত্রাসীদের সহিংসতা বন্ধ করা যাবে না। এই সহিংসতার নিগঢ় খুবই গভীরে প্রোথিত। ধর্মীয় উগ্রপন্থার যে ধর্মতাত্ত্বিক বয়ান রয়েছে তার গভীরে নিহিত এই সহিংসতার উৎস ও কারণ। এই ধর্মতাত্ত্বিক বয়ানের মোকাবেলায় এবং সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক ও আমাদের ভেতরে জেঁকে থাকা তাদের সবধরনের ঘাঁটি ধ্বংসকরণে জরুরি একটি ব্যাপকভিত্তিক কৌশল। মানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোনো শর্টকাট পথ নাই, নিয়মও নাই। সত্যিকার ইস্যুটি হলো তাদের উপর বলপ্রয়োগ করা।
ইতিমধ্যে দি ন্যাশনাল কাউন্টার-টেররিজম অথরিটি (ন্যাকটা) পুরাপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এর ফলে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের ব্যাপারটি পুরাপুরি ভেঙে পড়েছে। যেটি বিভিন্ন অঞ্চলে চরমন্থী গ্রুপগুলোর নেটওয়ার্ক ও কার্যক্রম মনিটরের জন্য মারাত্মক হুমকি। ন্যাকটা যখন সচল ছিলো তখন অনেকগুলো সন্ত্রাসী হামলা ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিলো।
পাকিস্তানের জন্য পেশোয়ার স্কুলের হত্যাকাণ্ড হতে পারতো জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি টার্নিং পয়েন্ট। এটি হতে পারতো তখনই যদি আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতারা তাদের প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকতেন। পেশোয়ার স্কুলের ট্রাজেডি পুরো জাতিকে এক করেছে। যেটা আগে কখনো ঘটেনি। এমনকি যারা এ ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইটাকে সমর্থন করতো না তাদের মনও পরিবর্তন হয়ে গেছে এমন ভয়াবহ ট্রাজেডির পর।
আশা করা যায়, আমরা অতীতে যেমন বহু ঘটনা দেখেছি সেজন্য সময়ের পরিবর্তনে যেন এই জাতীয় ঐক্য বদলে না যায়।
*লেখাটি ডন থেকে নেয়া হয়েছে
জাহিদ হোসাইন: লেখক ও সাংবাদিক
অনুবাদক: শাহাদাৎ তৈয়ব
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৪