‘ঈদের পর সরকার পতনের আন্দোলন’ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এমন ঘোষণার পর অনেকদিন কেটে গেছে। আন্দোলেনের রূপরেখা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে খালেদা জিয়া কয়েকটি জনসভায় দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি জনগণকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। বলেছেন, যেকোনো সময় ডাক আসতে পারে। ওই সময় সকলকে রাজপথে থাকতে হবে। এ আহবানের পর বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হলে কঠোর হাতে তা দমন করা হবে। অর্থাৎ রাজপথে নামলে আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠির আঘাত করা হবে, জলকামান- কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হবে। অর্থাৎ রাজপথ ও মাঠ থাকবে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর দখলে। বিএনপিকে আর কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না।
হাতে-নাতে এর প্রমাণ মিললো গাজীপুরে। শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) সেখানে ২০ দলীয় জোটের জনসভায় ভাষণ দেওয়ার কথা ছিলো জোটনেত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার। আগের দিনও খালেদা জিয়া ও তার দলের পক্ষ থেকে জনসভা অনুষ্ঠানের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি পরাজয় মানতে বাধ্য হয়েছে ছাত্রলীগের কৌশলের কাছে। প্রশাসন জনসভার স্থান ও তার আশেপাশে ১৪৪ ধারা জারি করে রাখে।
বিএনপি ১৪৪ ধারা ভাঙার সাহস দেখায়নি, পিছু হটেছে। সরকারের এক মন্ত্রী এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, রাজনীতি করতে হলে জেল-জুলুমের ভয় করলে চলবে না। প্রয়োজনে মার খেতে হবে, কারাগারে যেতে হবে। খুবই পুরনো ও মূল্যবান কথা।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা তার কথা মেনে বেশ সাবধানে চলাফেরা করছেন। কারণ, তাদের স্বাস্থ্য ও সম্পদ রক্ষা করাটা বেশি জরুরি। এরপরের জনসভাতেও এ কৌশল ব্যবহার করা হলে বিএনপি কী করবে?
অবশ্য এর আগেই রাজধানীসহ সারাদেশে পুলিশ বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের অনেক নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছে। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে একাধিক মামলা। জানুয়ারির শুরুতে মামলা ও গ্রেফতারের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ অবস্থায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা বেশ উদ্বেগের মধ্যে আছেন। আন্দোলনের সফলতা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তো আছেই। অনেকে মনে করেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়া, নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর দলের করণীয় নির্ধারণে ব্যর্থ হওয়া, আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে না পারা এবং গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচিতে ঢাকার রাজপথে না নামার ঘটনায় নেতাকর্মী ও সমর্থকরা হতাশ হয়েছেন।
পরের ঘটনাও সুখকর নয়। ঢাকা মহানগর কমিটির মধ্যে বিরোধ, সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে আংশিক ব্যর্থতা, ছাত্রদলের কমিটি গঠনের পর বিরোধ, সংঘর্ষ ইত্যাদি কারণে হতাশা বেড়েছে।
জন্মের পর থেকে এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে বিএনপি। যে ছাত্রদল একসময় রাজনীতির মাঠে সুদৃঢ় অবস্থানে ছিলো, মূল দলকে ‘শাসন’ করার ক্ষমতা রাখতো, সেই সংগঠনটি এখন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অবশ্য বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের অপকর্মও কম ছিলো না।
হালের ছাত্রলীগ প্রায়ই ছাত্রদলের সেসব ঘটনার সঙ্গে নিজেদের কাজকর্মের তুলনা করে। ছাত্রলীগও এখন যেন ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর দায়িত্ব পালন করছে। এতে উৎসাহ যোগাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কথা কেউ বিবেচনায় রাখেন না। রাখার প্রয়োজনও নেই। কারণ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার জন্য জনসমর্থনের বিষয়টি এখন খুবই তুচ্ছ।
সাম্প্রতিককালে ২০ দলীয় জোটের জনসভাগুলোতে বিপুল সংখ্যক লোক সমাগম হয়েছে। এটা দেখে নেতাকর্মীরা উৎসাহিত হয়েছেন। তাদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। তবে জনসভাগুলো আয়োজনের জন্য মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করার অভিযোগ থাকলেও নেতাকর্মীদের দাবি, তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে এটা সম্ভব করেছেন।
কিন্তু প্রান্তজনের বক্তব্য হচ্ছে, অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে সমাবেশে লোক বাড়ানো গেলেও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ সক্রিয় থাকবেন না বা সরকারের দমন-পীড়নের ফলে থাকতে পারবেন না। চূড়ান্ত আন্দোলন হতে হবে কম সময়ের, একথাও বলছেন তারা।
বিএনপির প্রায় সব নেতা প্রচারমাধ্যমে হুঙ্কার দিয়ে নানা কথা বলছেন। সাধারণ মানুষ এসব পছন্দ করেন না। আগাম কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এতে নেতাকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। বরং সরকার প্রতিরোধের কৌশল নির্ধারণ ও প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পাবে।
মানুষ জানে, বিএনপি একটি বড় দল। নির্বাচনে না গিয়ে যদি ভুলও করে থাকে তো ভবিষ্যতে তারা ঘরে বসে থাকবে না। তবে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে, জনগণ বিএনপিকে ভালোবেসে তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে মিছিল করে রাজপথে নামবে।
একথাও সত্য যে, অনেক মানুষ আর আওয়ামী লীগের শাসন মেনে নিতে পারছেন না। তাদের বুকের ভেতর ক্ষোভ জমা হচ্ছে।
রেজাউল করিম খান: সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৪