ঢাকা, বুধবার, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

এবং হত্যাকাণ্ড…

আমিনুল ইসলাম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৪
এবং হত্যাকাণ্ড…

একটা দৃশ্যকল্প চিন্তা করুন- একটা চার বছরের শিশু পাইপের ভেতরে পড়ে গিয়ে আলো-বাতাসহীন জায়গায় চিৎকার করছে তাকে উদ্ধার করার জন্য। প্রতিটি মুহূর্তে চেষ্টা করছে বেঁচে থাকার জন্য।

অন্যদিকে তাকে জীবিত উদ্ধার করার দায়িত্ব যাদের কাঁধে, সেই পরিণত মানুষগুলো খোলা আকাশের নিচে হাওয়া-বাতাস খেয়ে ঘোষণা করলেন, পাইপের ভেতরে কোনো মানবশিশুর অস্তিত্ব নেই!

নিশ্চয়ই ভাবছেন, তাহলে শিশুটির কি হবে? যা হবার ঠিক তাই হবে! শিশুটি একটা সময় বেঁচে থাকার সংগ্রামে হার মেনে মৃত্যুকে বরণ করবে! এখন যদি ভেবে থাকেন, এটি কোন সিনেমা বা নাটকের দৃশ্যকল্প তাহলে ভুল করছেন।

এ দৃশ্যটিই পুরো বাংলাদেশের মানুষ অবলোকন করলো শুক্রবার দুপুর থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত।

রাজধানীর শাহজানপুরে ওয়াসার গভীর নলকূপে পানির পাইপে যে শিশুটি পড়ে গিয়েছিলো সেই শিশু জিহাদকে শনিবার প্রায় ২৩ ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হয়েছে। তবে যখন তাকে উদ্ধার করা হয়েছে ততোক্ষণে তার শরীরে প্রাণের অস্তিত্ব নেই! এর চেয়েও অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, ফায়ার সার্ভিসের লোকজন অফিসিয়ালি উদ্ধার কাজ বন্ধ ঘোষণার করার পর স্থানীয়রা যখন সেখানে নিজেরা উদ্ধার কাজে যাবার সুযোগ পান ঠিক তখনই একদম নিজস্ব প্রযুক্তিতে তারা শিশুটিকে বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। আমাদের ফায়ার সার্ভিসের দক্ষতা, প্রযুক্তিতে তারা আসলেই অনেক পিছিয়ে কি-না কিংবা অন্যান্য অভিযোগগুলোর আগে একটি প্রশ্নই বার বার মনে হচ্ছে। সেটি হচ্ছে, রাত তিনটার সময় যখন তাদের কর্মকর্তারা অভিযান চলার সময়ই এক রকম ঘোষণা করেছেন, আসলে পাইপের ভেতরে কোনো মানুষ নেই, তখন নিশ্চয়ই উদ্ধার কাজে শিথিলতা চলে আসে।

একবারও কি তারা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছিলেন, সেখানে আসলেই বাচ্চাটি নেই? পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে এ ধরনের মন্তব্য করে কি তারা উদ্ধার কাজের ব্যাঘাত ঘটাননি! যারা উদ্ধার কাজে নিয়োজিত ছিলেন, তখন তারাও নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছেন, ভেতরে কেউ নেই। আপনি যদি ধরেই নেন, ভেতরে কেউ নেই তাহলে সেই কাজ আসলে আপনি কতোটা মনোযোগ দিয়ে করবেন?

যেখানে প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট গুরুত্বপূর্ণ, একটি শিশুর বাঁচা-মরা নিয়ে প্রশ্ন সেখানে কর্মকর্তারা ঘোষণা করে বসলেন, আসলে পাইপে কোনো মানব সন্তান নেই! পুরো দেশবাসী টেলিভিশনের মাধ্যমে সরাসরি দেখলেন ও শুনলেন, এনএসআই’র একজন কর্মকর্তা পর্যন্ত বলছেন, ভেতরে কেউ নেই। এটি হয়তো একটি গুজব হয়ে থাকতে পারে!

বাচ্চাটি হয়তো তখনও বেঁচে ছিলো, বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো! আর আমরা যারা বুঝতে শিখেছি, যারা দায়িত্ব নিতে শিখেছি তারা কেউ ঘরে বসে এই ঘটনায় রাজনীতি মেশানোর চেষ্টা করলাম। কেউ পুরো ঘটনাটি নিয়ে হাসাহাসি করছিলেন আর যারা সেখানে উদ্ধার করছিলেন, তারাও ঘোষণা করলেন, সেখানে কেউ নেই, এটি হয়তো একটি গুজব! তখনও হয়তো বাচ্চাটি বেঁচেই ছিলো।

পরিণত বয়স্ক ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীরা যখন সেখানে কিছু নেই বলে উদ্ধার কাজ বন্ধ ঘোষণা করলেন, ততক্ষণে হয়তো অবুঝ শিশুটির দেহে আর প্রাণ নেই। সে জানতেও পারলো না, আমরা পরিণত বয়স্ক মানুষগুলো নলকূপের পানির পাইপ খোলা রেখে যে অন্যায় করেছি, সেটি ছিলো কেবল হত্যাকাণ্ডের একটি প্রাথমিক প্রক্রিয়া। এরপর কেবল এই চার বছরের শিশুটিকে হত্যা করার জন্য যুক্ত হয়েছেন আরও পরিণত মানুষরা।

ক্ষমা করে দিও শিশু জিহাদ। আমরা পরিণত হয়েছি, কিন্তু মানুষ হইনি।

আমিনুল ইসলাম, গবেষক: tutul_ruk@yahoo.com
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।