ঢাকা: একাত্তরে হত্যা-গণহত্যার দায়ে আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষনেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে করা তার আপিল আবেদন আংশিক খারিজ করে দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।
প্রতিবাদে বুধবার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জামায়াত।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মূল হোতার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ ছয়জনকে হত্যা-গণহত্যার দায় (১১ নম্বর অভিযোগ) প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সর্বোচ্চ দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে আপিল মামলার রায়ে। ১১ নম্বর ছাড়াও ১২ নম্বর অভিযোগে রঞ্জিত দাস লাতু ও টুন্টু সেন রাজুকে হত্যার দায়েও কাসেমের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। তবে চূড়ান্ত রায়ে প্রমাণিত না হওয়ায় এ অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত মোট ১০টি অভিযোগের মধ্যে আরও ৬টি অভিযোগে মীর কাসেমের সাজা বহাল এবং আরও ২টি থেকে অব্যাহতি ও খালাস দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসির পাশাপাশি ৫৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন তিনি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী কিলিং স্কোয়ার্ড আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষনেতা ছিলেন জামায়াতের বর্তমান কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী। সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) ও জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ (যৌথ দায়বদ্ধতা) হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে আলবদর বাহিনী ও ছাত্রসংঘের অপরাধের দায়ও তাই বর্তেছে তার ওপরে।
মঙ্গলবার (০৮ মার্চ) সকাল পৌনে দশটায় দেশের এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত এ রায় দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।
ট্রাইব্যুনালে আটজনকে নির্যাতনের পর হত্যা ও মরদেহ গুম এবং ২৪ জনকে অপহরণের পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে আটকে রেখে নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী ১৪টি অভিযোগে অভিযুক্ত হন মীর কাসেম আলী।
এ ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে। বাকি ৪টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি প্রসিকিউশন।
১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি অর্থাৎ ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং ৪টি অর্থাৎ ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেননি বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়।
এর মধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে সর্বসম্মত ও ১২ নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা।
ফাঁসি ছাড়াও প্রমাণিত অন্য ৮টি অভিযোগে আরও ৭২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পান চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা মীর কাসেম আলী। এর মধ্যে প্রমাণিত ফারুককে অপহরণ-নির্যাতনে (২ নম্বর অভিযোগ) ২০ বছর ও নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতনের (১৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড পান তিনি। এছাড়া অপহরণ, আটক ও নির্যাতন সংক্রান্ত ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে ৭ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
অভিযোগগুলোর মধ্যে ৪, ৬ ও ১১ নম্বর বাদে বাকি ৭টিতেই সাজা বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। ফলে একটিতে ফাঁসি ও দু’টিতে ৭ বছর করে ১৪ বছরের কারাদণ্ডাদেশ কমেছে মীর কাসেমের।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ০২ নভেম্বর মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশের ওই রায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এ রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ৩০ নভেম্বর খালাস চেয়ে মীর কাসেম আলী আপিল করেন।
সাত কার্যদিবসে এ আপিল মামলার শুনানি শেষে সর্বোচ্চ আদালত গত ২৪ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের এ যুদ্ধাপরাধী নেতার রায়ের দিন ধার্য করেন ০৮ মার্চ।
মীর কাসেম আলীর মামলাটির মাধ্যমে সর্বোচ্চ আদালতে রায় হলো ৭ম আপিল মামলার।
এর আগে ঘোষিত ছয়টি আপিল মামলার চূড়ান্ত রায়ের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত চারজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। বাকি দু’টির মধ্যে একটির পূর্ণাঙ্গ ও একটির সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশ করেছেন আপিল বিভাগ।
চূড়ান্ত রায়ের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আর গত বছরের ১১ এপ্রিল জামায়াতের অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং ২১ নভেম্বর জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি বহাল রেখে ৬ষ্ঠ আপিল মামলার রায় দেওয়া হয়েছে গত ০৬ জানুয়ারি।
অন্যদিকে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির দণ্ডাদেশ কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন আপিল বিভাগ। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর সর্বোচ্চ সাজা পুনর্বহালের আরজিতে রাষ্ট্রপক্ষ আর খালাস চেয়ে আসামিপক্ষ রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৬
ইএস/এএসআর
** ফাঁসির রায় জেনেছেন মীর কাসেম
** এ রায়ে যুদ্ধাপরাধ বিচারের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সম্পন্ন হয়েছে
** ‘স্বামী বেঁচে থাকলে মীর কাসেমের মুখে থুথু দিত’
** রায়ে স্বস্তি কামরুলের
** রিভিউ করবেন মীর কাসেমের পরিবার
** মীর কাসেমের চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষা
** রায় ঘিরে সুপ্রিম কোর্টে ব্যাপক নিরাপত্তা
** লিখিত বক্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানাবে পরিবার