ঢাকা, রবিবার, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১১ রজব ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সন্ধ্যা নামলেই হাতি আতঙ্ক, আক্রমণে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা

 সৈয়দ বাইজিদ ইমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫
সন্ধ্যা নামলেই হাতি আতঙ্ক, আক্রমণে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা ...

চট্টগ্রাম: আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও বাঁশখালী উপজেলার ৪০টিরও বেশি গ্রামের মানুষ হাতি আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ওইসব পাহাড়ি এলাকায় বনাঞ্চলের ভূমি স্থানীয়রা দখলে নেওয়ায় ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হতে থাকে হাতির আবাস।

এতে ক্ষুব্ধ হাতির দল খাবারের সন্ধানে পালাক্রমে এখন লোকালয়ে হানা দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে।  

কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠানের দৌলতপুর, দক্ষিণ শাহ মীরপুর এবং আনোয়ারার গুয়াপঞ্চক, বৈরাগ, মোহাম্মদপুর, ফকিরখিল, বটতলী, হাজিগাঁও, গুচ্ছগ্রামে গত ৬ বছর ধরে তিন শতাধিক পরিবারের বসতঘর ভাঙচুর ও শত শত একর ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বন্যহাতির তাণ্ডবে।

গত ১০ বছরে হাতির আক্রমণে ১৬ জন মারা গেছেন।

বাঁশখালী উপজেলায় গত কয়েক বছরে হাতির তাণ্ডবে ১৫ জনের মৃত্যু ও অন্তত ৫০ জন কৃষক আক্রান্ত হয়েছেন। গত ১০ বছরে ১৯টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ও পুঁইছড়ি ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকা থেকে হাতির পাল খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসে।

এদিকে, হাতির আক্রমণের ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন কোরিয়ান ইপিজেড কারখানার প্রায় ৩৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। সর্বশেষ দায়িত্বরত অবস্থায় মরিয়ম আশ্রম এলাকায় সম্প্রতি মো. হাকিম নামের এক সিকিউরিটি গার্ডের ওপর হামলা করে বন্যহাতির দল। আহত সিকিউরিটি গার্ডের বাড়ি আনোয়ারা উপজেলার চাতরী গ্রামে। তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর আগে গেল বছরের ৬ সেপ্টেম্বর কেইপিজেডের গলফ কোর্সে হাতির আক্রমণে ডি হাং কং নামে বাংলাদেশে কোরিয়ান ন্যাশনালের একজন বিনিয়োগকারী গুরুতর আহত হয়।

কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) বিদেশি নাগরিকসহ প্রায় ৩৩ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মস্থল। প্রতিদিন রাতে কোরিয়ান ইপিজেড এলাকায় হানা দিচ্ছে বন্যহাতির পাল। যার ফলে সন্ধ্যায় কারখানা ছুটি হলে আতঙ্কে থাকেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। আতঙ্কে রাত কাটান কেইপিজেডের আশেপাশের এলাকার মানুষও। এরইমধ্যে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের নিরাপত্তা এবং এলাকাবাসীর জান-মালের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক চিঠি দিয়েছেন।  
 
কেইপিজেড সিকিউরিটি দপ্তর সূত্র জানায়, সর্বপ্রথম ২০১২ সালের ১ মার্চ শাহ মীরপুরের জুয়েল দাশ (১৩), ২০১৮ সালের ১৩ জুলাই মুহাম্মদপুরের আবদুর রহমান (৭০), একই বছর ১৮ আগস্ট বটতলা বারখাইনের আবদুল মোতালেব (৬৮), ৩১ অক্টোবর বড় উঠানের জালাল আহমদ (৭০), ২০১৯ সালের ২৬ জুন বটতলী গুচ্ছগ্রামের মোমেনা খাতুন (৬৫), ১৪ জুলাই বৈরাগের আক্তার হোসেন (৫০), ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি বটতলীর মো. সোলাইমান (৭০), ৩ ফেব্রুয়ারি গুয়াপঞ্চকের দেবী রানি দে (৪০), ২০ ফেব্রুয়ারি শাহ মিরপুরের মায়া বড়ুয়া (৭০), ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর গুয়াপঞ্চকের অজ্ঞাত (৫০), ২০২৩ সালের ৬ জুলাই বারখাইনের ছাবের আহমদ (জুনু) (৭০), ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দৌলতপুরের সৈয়দ আহমদ (লুতু মিয়া) (৫০), ২৩ সেপ্টেম্বর গুয়াপঞ্চকের মো. কাশেম (দুলাল) (৬০), এদিন একই এলাকার রেহেনা বেগম (৩৫), ২১ অক্টোবর বটতলীর হালিমা খাতুন (৬৫), ২৩ অক্টোবর বড় উঠানের মো. আকবার (৩৮) এর মৃত্যু হয়।

কেইপিজেড সূত্রে জানা যায়, আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলার ওই এলাকায় বর্তমানে ৪৭টি কারখানায় প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাদের অনেককে হেঁটে কারখানায় যাতায়াত করতে হয়। এ সময় তারা হাতির ভয়ে থাকেন। পাহাড়ে অবস্থান নেওয়া হাতির পাল কেইপিজেডের গাছপালা ও বিভিন্ন স্থাপনাসহ প্রায় ২ কোটি টাকার ক্ষতি করেছে। সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। দায়িত্বরত বিদেশি নাগরিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, কারখানার শ্রমিক ও নিরাপত্তা প্রহরীরাও ভুগছেন আতঙ্কে। হাতির আক্রমণে পার্শ্ববর্তী গ্রামের ২০ জন নারী-পুরুষের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে শতাধিক।

কেএসআইয়ের জান্নাতুল ফেরদৌস নামের এক নারীশ্রমিক বাংলানিউজকে বলেন, কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার সময় ভয়ে ভয়ে যেতে হয়। কখন জানি হাতির পাল সামনে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে হাতির এ তাণ্ডব চললেও প্রশাসন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। রাতের বেলায়ও শঙ্কায় থাকি, কখন বাড়িতে হাতির পাল হানা দিচ্ছে। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে এ এলাকায় থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

বাঁশখালী উপজেলার কৃষকদের অভিযোগ, বাঁশখালী বিশাল এলাকাজুড়ে নানা ধরনের চাষাবাদ হয়। হাতির আক্রমণের ভয়ে কৃষকরা চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। পুঁইছড়ি ও সাধনপুর এলাকায় হাতির আক্রমণে কৃষকের মৃত্যুর ঘটনায় কৃষকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। পাহাড়ি এলাকায় কৃষি জমি থাকলেও বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদি পড়ে রয়েছে।  

বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়নেন কৃষক জকির উদ্দিন দুষলেন বনবিভাগের কর্মকর্তাদের। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পাহাড়ি এলাকায় বন বিভাগের তৎপরতা কমে গেছে। যার কারণে অসাধুরা সেখানে বসতি গেড়েছে। বনের গাছ কেটে সাবাড় করছে। তাই হাতির পাল লোকালয়ে ও কৃষি জমিতে আক্রমণ করছে। হাতির ভয়ে পাহাড়ের নিম্নাঞ্চলে অনেক অনাবাদি জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এসব জমিতে ধান, তরমুজ ও সবজি চাষ করা গেলে অনেক টাকা আয় হবে। হাতির ভয়ে অনাবাদি জমিতে চাষাবাদে অনীহা প্রকাশ করছেন কৃষকেরা।

কেইপিজেড করপোরেশন (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, হাতি তাড়ানোর বিষয়ে ২০২২ সালে ৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আরেকটি কমিটি এসে কেইপিজেড পরিদর্শন করে যায়। কেইপিজেডের পক্ষ থেকে বেতন দিয়ে এআরটি টিম রাখা হয়েছে। এছাড়া হাতিগুলোর কারণে কেইপিজেডের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিনিয়োগকারীরাও ভয়ে আছে। তাই এটা কেইপিজেডের জন্যও বড় ক্ষতিকারক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সরকার উদ্যোগ নিলে হাতি অপসারণে সব ধরনের সহযোগিতা করবে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ।  

স্থানীয়রা জানান, হাতিগুলো কর্ণফুলী এলাকায় এসেছে প্রায় ১০ বছর আগে। বিভিন্ন সময় তারা লোকালয়ে নেমে আসে। জমির ফসল ও জানমালের ক্ষতিসাধন করে। কোনভাবেই হাতিগুলোকে দমানো যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনের কাছে কয়েক দফা নালিশ করা হয়েছে। নিরুপায় হয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি আশ্বস্ত করেছেন, হাতিগুলোকে অভয়ারণ্যে ফেরানোর উদ্যোগ নেবেন।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টাচার্য্য বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে হাতগুলোর বিষয়ে সম্প্রতি বেশ কয়েকবার সভা হয়েছে। সেখানে মাননীয় উপদেষ্টাও উপস্থিত ছিলেন। প্রথমে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে আরেকটি সাব কমিটি করা হয়, যাদের দ্রুত সময়ে কিছু নির্দেশনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রায় নির্দেশনা প্রতিপালন হয়েছে। এরমধ্যে একটি হলো চায়না ইকোনমিক জোনের পাশে সরকারি জায়গা হাতির বসবাসের উপযুক্ত করা এবং সেখানে  জলাধার খনন করার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়াও পাঁচটি এলিফ্যান্ট রেসকিউ টিম গঠন করা হয়েছে। তারা সার্বক্ষণিক কাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, হাতিগুলোকে সংরক্ষণের জন্য আমাদের নিয়মিত টহল দল কাজ করছে। স্থানীয় জনগণকে আমরা প্রতিনিয়তই সচেতন করছি। যদি হাতিগুলো কারও সম্পদের ক্ষতিসাধন করে, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়াও হাতির আক্রমণে কেউ গুরুতর আহত হলে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন, যদি মারা যান তাহলে ৩ লাখ টাকা পাবেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার।

আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, আমি নতুন এসেছি। এখানে বিভিন্ন সময়ে হাতির আক্রমণের শিকার অনেক ব্যক্তি আমাদের কাছে বিচার নিয়ে এসেছেন। হাতিগুলো খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে এসে ফসলের ক্ষতিসাধন করে। আমরা এ হাতিগুলোকে কিভাবে অভয়ারণ্যে ফেরানো যায়, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসককে অবহিত করেছি।

মাহুত এনে হাতি ফেরানোর কার্যক্রম

প্রায় দশ বছর আগে দলবদ্ধ হাতির পাল এসেছিল আনোয়ারা-কর্ণফুলী সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায়। সেখান থেকে তিনটি হাতি কোরিয়ান ইপিজেড এলাকায় দলছুট হয়ে থেকে যায়। পরে প্রায় সময় খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসে হাতিগুলো, নষ্ট করে ফসল। এ পর্যন্ত হাতির আক্রমণে নিহত হয়েছেন ১১ জন, আহত হয়েছেন অনেকে।

স্থানীয়রা চেষ্টা করেও হাতিগুলোকে গহীন পাহাড়ে ফেরাতে পারেননি। উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রশাসন থেকে নানান উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ব্যর্থ হয়।

এ অবস্থায় সেই হাতিগুলোকে অভয়ারণ্যে ফেরাতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। তিনি পার্বত্য জেলা থেকে মাহুত এনে হাতিগুলোকে বশে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। পরে সে পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন হয়নি।

জানা গেছে, হাতি রক্ষায় ২০১৯ সালে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার। এর মধ্যে চলতি বছর ২০টি হাতি মারা গেছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। এছাড়া হত্যা করা হয়েছে ১৩টি। কোনোমতে টিকে আছে ২৬২টি বন্য হাতি। জমির ফসল পাকার সময় হাতি লোকালয়ে চলে আসে। এজন্য শ্রীলঙ্কা-থাইল্যান্ডে বন বিভাগ পেশাদার মাহুত নিয়োগ দেয়। এই মাহুতরা জিপিএস সিস্টেমের মাধ্যমে হাতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন ও খাবারের ব্যবস্থা করেন। এরপর লোকালয় ও জমির দিক থেকে তাদের চলাচলের পথ ঘুরিয়ে অভয়ারণ্যমুখি করে দেন। হাতির নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিতে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় বন বিভাগ ১২টি করিডোর সংরক্ষণে নির্দেশনা চেয়েছে।  

উল্লেখ্য, যদি কেউ হাতি হত্যা করে- তাহলে ৭ বছরের জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং এ অপরাধ যদি কেউ পুনরায় করে, তাহলে ১২ বছরের জেল ও ১৫ লাখ জরিমানা করার বিধান রয়েছে। বাঁশখালীর লটমনিতে হাতি হত্যার দায়ে দেশে প্রথমবারের মতো ২ জনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫
বিই/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।