ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

জীবনযুদ্ধে হার না মানা বানুর গল্প

মো. রাজীব সরকার, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২০
জীবনযুদ্ধে হার না মানা বানুর গল্প প্রতিবন্ধী হয়েও জীবনযুদ্ধে হার মানেননি বানু।

গাজীপুর: প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেন বানু আক্তার (৩৪)। জন্ম থেকেই তার দু’টি হাত নেই।

জন্মের পর থেকে প্রতিটি মুহূর্তে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাকে। হাত না থাকলেও দু’টি পা দিয়েই তিনি রান্না থেকে শুরু করে বাসন মাজা, কাপড় ধোয়াসহ সংসারের সব কাজ করছেন। এমনকি পায়ের সাহায্যে পুঁতি দিয়ে তিনি তৈরি করছেন রকমারি পণ্য। প্রতিবন্ধী হয়েও বানু জীবনযুদ্ধে হার মানেননি।

দু’টি পা দিয়েই তিনি পুঁতির মালা, ব্যাগ, নৌকা, ফুল ও ফলসহ বাহারি নকশার পণ্য তৈরি করছেন। এছাড়াও, পা দিয়েই সেলাই মেশিন চালিয়ে তৈরি করছেন জামা-কাপড়। আর এসব বিক্রি করে চলছে তার সংসার।

নীলফামারীর ডিমলা থানার সাতনাই বালাপাড়া এলাকায় ১৯৮৬ সালে জন্ম নেন বানু। তার পিতার নাম আব্দুস সাত্তার। বানু বর্তমানে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ী থানাধীন দক্ষিণ হরিনাচালা এলাকায় মুনসের আলী পাঠানের বাড়িতে ভাড়া নিয়ে ছেলের সঙ্গে বাস করছেন।

এলাকাবাসী ও বানু আক্তার জানান, জন্মের পর বাবা মাসহ আত্মীয়-স্বজনরা বানুকে দেখে ভয় পেতো। দিন দিন পরিবারে কাছে অবহেলার পাত্রে পরিণত হন তিনি। এভাবেই বুকভরা কষ্ট নিয়ে বড় হতে থাকেন বানু। গ্রামের বাড়িতে থাকতেই সেলাই মেশিনে জামা বানানোর কাজ শেখেন তিনি।
এক পর্যায়ে ১৭ বছর বয়সে নীলফামারীর জলঢাকা থানার মীরগঞ্জ পাঠানপাড়া এলাকার খোরশেদ আলমের সঙ্গে তার বানু প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, কিন্তু পরিবারের অবহেলার কারণে ২২ বছর বয়সে তিনি পাড়ি জমান গাজীপুরের কোনাবাড়ী থানাধীন দক্ষিণ হরিনাচালা এলাকায়। এখানে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন তিনি। এর কিছুদিন পরেই খোরশেদ আলমের সঙ্গে বানর বিয়ে হয়। পরে বানু ওই এলাকায় ঝুট গুদামে তিন বছর কাজ করেন। পাশাপাশি পুঁতি দিয়ে মালা ও ব্যাগসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করা শেখেন। পরে জরুন এলাকায় কেয়া স্পিনিং মিলে অপারেটর হিসেবে চাকরি নেন জীবন সংগ্রামে অদম্য এ নারী। কিন্তু ছয় মাস পর চাকরি ছেড়ে দেন। নিজে পড়াশোনা না করলেও মানুষের কাছে সহযোগিতা ও পুঁতির সামগ্রী বিক্রি করে স্বামীকে পড়াশোনা করতে সাহায্য করেন তিনি। পরে তার স্বামী মাস্টার্স পাস করেন। দাম্পত্য জীবনে তাদের কোলজুড়ে আসে বিল্লাল হোসেন নামে ফুটফুটে এক ছেলে। এখন বিল্লালের বয়স ছয় বছর। এরই মধ্যে তিনি আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন একাধিক বার। পুঁতি দিয়ে বানানো নৌকা উপহার দেন প্রধানমন্ত্রীকে। তার কারুকাজে মুগ্ধ হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বামীকে সরকারি চাকরি দেওয়ার অনুরোধ করেন বানু। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সচিবালয়ে চাকরি হয় তার স্বামী খোরশেদের।

কিন্তু বানুর সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। । সচিবালয়ে চাকরি হওয়ার কিছুদিন পরই বানুকে ফেলে চলে যান খোরশেদ। তারপরও হাল ছাড়েননি বানু। খোরশেদ আবার তার কাছে ফিরে আসবে এই ভেবে দেড় বছর অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু স্বামী আর ফিরে আসেনি। কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে বানু আবার দেখা করেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। পরে প্রধানমন্ত্রীকে সব বলেন তিনি। সেসময় প্রধামন্ত্রীর নির্দেশে খোরশেদকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। পরে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন বানু।

স্থানীয় বাসিন্দা জাকির হোসেন জানান, বানু আক্তারের আত্মবিশ্বাস আছে। তিনি প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও কখনো ভেঙে পড়েননি। এলাকার সবাই তাকে চেনে। তিনি এক সংগ্রামী নারী।
বানু জানান, তার স্বপ্ন প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোল, যেখানে তাদের সেলাই এবং পুঁতির সামগ্রী তৈরি করা শেখানো হবে। তবে টাকার অভাবে তিনি তা করতে পারছেন না। তাই সমাজের বিত্তবান এবং সরকারের সহযোগিতা চান তিনি। অনেকেই বিকাশে টাকা পাঠিয়ে মোবাইলে তাকে পুঁতির পণ্য তৈরির অর্ডার দেন। সেসব পণ্য তৈরি করে কুরিয়ারের মাধ্যমে ক্রেতার কাছে পাঠান বানু।

বাংলাদেশ সময়: ১০২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২০
আরএস/এফএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।