কুষ্টিয়া: ‘কিশোর গ্যাং’ কুষ্টিয়া শহরের এখন এক আতঙ্ক। একের পর এক শহরে নিজেদের দলের ক্ষমতা ও দাপট দেখাতে প্রায় মরিয়া হয়ে উঠছে তারা।
দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে লেখাপড়া থেকে অমনোযোগী হয়ে স্মার্টফোন ও এসব গ্রুপিং-এ জড়িয়ে যাচ্ছে কিশোররা। এতে তাদের ভবিষ্যত নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। সেইসঙ্গে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এসব কিশোর গ্যাংগুলো কতটা বিস্তার লাভ করেছে।
কিশোর গ্যাং, নেশা এবং চুরি-ডাকাতি সব একই সূত্রে গাঁথা। সন্ধ্যার পর থেকে এসব অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়। কুষ্টিয়ার শেখ রাসেল হরিপুর-কুষ্টিয়া সংযোগ সেতুসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ জনসমাগম স্থানগুলোতে একাধিক কিশোর গ্যাং তাদের সদস্যদের নিয়ে বেপরোয়া মোটরসাইকেল মহড়া দিয়ে জানান দেয় নিজেদের। এভাবেই তারা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এতে দিন দিন আতঙ্কিত হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষ।
সম্প্রতি ১৮ নভেম্বর (বুধবার) বিকেলে কুষ্টিয়া শহরে কিশোর গ্যাং এর মধ্যে আধিপত্ত্য বিস্তার ও ফেসবুকে কে কত শক্তিশালী এ নিয়ে কুষ্টিয়া কালেক্টর স্কুলের লাবিব আলমাস নামে ৮ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে মারধর করে অপর গ্যাং এর সদস্যরা। মারধরের প্রমাণ এবং তাদের শক্তি জাহির করতে মারধরের ঘটনাটি ভিডিও করে ফেসবুক গ্রুপে ছেড়ে দেয়। ভিডিওতে তাদের কথপোকথনেও উঠে আসে কুষ্টিয়ার কিশোর গ্যাং দের বিচরণের দৃশ্য।
১২ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) কুষ্টিয়ার আলোচিত কিশোর গ্যাং এস কে সজিব, সিয়াম ও নিবিরদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে প্রকাশ্যে ইসলামীয়া কলেজ গেটে ছুরিকাঘাত করে কুষ্টিয়া মজমপুর এলাকার মোহাম্মদ শেখের ছেলে হৃদয় হোসেনকে। হৃদয় বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাং ‘নিবির ও সিয়াম’ গ্রুপের সিয়াম (১৭), ইফতি (১৬) ও অভি (১৬) নামের তিন জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
০৩ জুলাই (শুক্রবার) কুষ্টিয়া শহরের থানা পাড়া পুলিশ ক্লাব সংলগ্ন মাঠের ফুটবল খেলার সময় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কথা কাটাকাটি হয় কিশোর তরিকুল ইসলাম ও মিনারুল ইসলামের। একপর্যায়ে মিনারুল তার পকেটে থাকা ছুরি বের করে তরিকুলের শরীরে উপর্যুপরি আঘাত করলে মারা যায় তরিকুল।
১৪ জানুয়ারি (রোববার) আগুন পোহানোকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়ার চৌড়হাস এলাকায় শামীমের সঙ্গে সোহানের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সোহানের বন্ধু আসিফ কোমর থেকে ছুরি বের করে শামীমকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। শামীম ও পাল্টা সোহানকে ছুরিকাঘাত করে। এ সময় তাদের চিৎকারে স্থানীয়রা ছুটে এসে দুইজনকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
এছাড়া ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর (রোববার) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শহরের পিটিআই সড়কে সরকারি সিটি কলেজের সামনে জেলখানা মোড়ে কয়েকজন তরুণের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এসময় একজন ধারালো ছুরি দিয়ে পলাশসহ দুইজনকে আঘাত করে পালিয়ে যায়। স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে পলাশ মারা যায়।
সম্প্রতি কুষ্টিয়া শহর এলাকায় বিভিন্ন অঞ্চল ও গ্রুপভিত্তিক অন্তত ২২টি কিশোর গ্যাং দোর্দণ্ড প্রতাপে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহরজুড়ে। তারা বাসা থেকে বেরিয়ে অভিভাবকদের দৃষ্টি এড়িয়ে মাদক সেবনসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে মনে করেন সচেতন মহল।
কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের অত্যাচারে শহরের বাইরে থেকে যারা এসে শহরে পড়াশোনা করে এমন শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীদের গ্রুপিং না করলে অত্যাচারিত হতে হচ্ছে।
শহরের ছাত্রাবাসে থাকা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানায়, আমাদের মেসে চুরি এখন নিয়মিত ঘটনা, আমরা বাইরে থেকে পড়াশোনা করতে এসেছি চোর দেখতে পেলেও ভয়ে কিছু বলতে পারি না, কারণ ওরা বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে।
কুষ্টিয়ায় কিশোর অপরাধীদের ধরতে এবং আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে অদৃশ্য কারণে কিশোর অপরাধের শীর্ষ অবস্থান থেকে যারা নেতৃত্ব দেন তাদের কিছুই হয় না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেয় তারা।
এদিকে কুষ্টিয়া কোর্টের দেওয়া বিভিন্ন মামলার রায়েও জেলার কিশোর অপরাধীদের সত্যতা উঠে এসেছে।
৪ জুন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া কাজীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা কয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্রী জয়া খাতুনকে পালাক্রমে ধর্ষণের পরে হত্যার ঘটনায় লিমন (১৭), সাহিল (১৭) এবং হিমেল (১৭) নামের তিন কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
২৩ আগস্ট (রোববার) এ ঘটনায় কুষ্টিয়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আদালতের বিচারক মুন্সী মো. মশিয়ার রহমানের এজলাসে সোপর্দ করা হলে তাদের কিশোর সেলে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। যা পরে বিচারিক হাকিমের আদালতে ১৬৪ ধারা জবানবন্দিতেও স্বীকার করে ওই কিশোররা।
২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আদালতের বিচারক মুন্সী মো. মশিয়ার রহমান একটি ধর্ষণ মামলায় আসামি কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর গ্রামের কৌতুক শেখের ছেলে সাদ্দাম হোসেন অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় তাকে ১০ বছর কারাদণ্ডসহ এক লাখ টাকা জরিমানা করেন। এ মামলায় সহায়তাকারীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন তিনি।
গোয়েন্দা শাখার একটি সূত্রমতে, কুষ্টিয়া শহর জুড়ে প্রায় ১১টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। যাদের বয়স ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। কুষ্টিয়ায় বর্তমানে ‘ব্যাড বয়েজ’, ‘০০৭’, ‘বিএসবি গ্রুপ’সহ বড় চারটি গ্রুপ রয়েছে, যাদের সদস্য সংখ্যা অর্ধশত। শহরের থানাপাড়া, কালিশংকরপুর, কোর্টপাড়া, কুঠিপাড়ায় বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং তাদের নানা অপকর্ম চালাচ্ছে। এগুলো বেশিরভাগই কিছু অসাধু রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দাপটে চলে।
কুষ্টিয়ার হরিপুর এলাকার একাধিক বাসিন্দা বাংলানিউজকে জানান, কিশোর গ্যাং ইদানিং খুবই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তাদের ক্ষমতা ও লোকবল দেখাতে শেখ রাসেল হরিপুর-কুষ্টিয়া সংযোগ সেতুর উপরে দলে দলে মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়াভাবে চলাচল করে। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। সেইসঙ্গে তারা নদীর ধারে বসায় মাদকের আসর।
কুষ্টিয়ার শিশু অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্বরত প্রবেশন অফিসার আরিফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, অভিভাবকদের নজরদারির অভাবে অধিকাংশ কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কুষ্টিয়ায় বর্তমানে সংঘটিত অন্তত ৪০টি শিশু-কিশোর অপরাধের ঘটনায় জড়িত শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করছি।
অপরাধ সংঘটনের পর শিশু সুরক্ষা আইনের বিধিমতে, অভিভাবকদের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগে প্রদত্ত নির্দেশিকার আলোকে তাদের আইনি সহায়তাসহ সব রকম নার্সিং করা হচ্ছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের নেতা কারশেদ আলম বাংলানিউজকে জানান, দিন দিন অভিভাবকদের দায়িত্বে অবহেলা ও ব্যস্ততার কারণে ঠিকমতো বাচ্চাদের সময় না দেওয়ার ফলে অধিকাংশ কিশোররা বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে। আমাদের উচিত ছেলে মেয়েরা কখন, কোথায়, যাচ্ছে কাদের সঙ্গে মিশছে, কি করছে এগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখা। বর্তমানে কুষ্টিয়ার কিশোর অপরাধ প্রবণতা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব নিয়ে আমরা সচেতন নাগরিক সমাজ বেশ চিন্তিত। কারণ এসব কিশোরদের হাতে এখন আধুনিক প্রযুক্তি কলমের পরিবর্তে মাদক, চাকু চলে আসছে। এগুলো বন্ধ না হলে আগামীতে সমাজে ভয়াবহ অবক্ষয় হতে পারে।
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে অনেকটা অভিভাবকদের উদাসিনতা দায়ী। পুলিশের কাজ অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা। কিন্তু কিশোরদের অপরাধী তৈরি হয়ে ওঠার আগেই পারিবারিকভাবে তা দমন করা যায়।
তিনি আরো বলেন, কিশোরদের প্রতি সবাইকে সহনশীল হতে হবে। শিশু-কিশোরদের প্রতি অভিভাবকদের দায়িত্ব বেশি। স্কুলগামী শিশু ও কিশোরদের দিকে অভিভাবকরা যথাযথ নজর দিলে কিশোর অপরাধ দমন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২০
আরএ