রাজশাহী: দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টমেটো উৎপাদন হয় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায়। প্রায় দুই দশক ধরে বরেন্দ্রভূমি খ্যাত গোদাগাড়ী সদর ও পদ্মার চরে টমেটোর চাষ কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
কয়েক হাজার চাষি কেবল টমেটো চাষ করেই হয়েছেন স্বাবলম্বী। চলতি মৌসুমে টমেটোর আশানুরূপ ফলন হওয়ায় এবং ভালো দাম পাওয়ায় ক্ষেতের কাঁচাপাকা অর্থাৎ লাল-সবুজ টমেটো হাসি ফুটিয়েছে কৃষকের মুখে। রাসায়নিক সার ছাড়াই উৎপাদিত টমেটো স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, প্রায় দুই যুগ ধরে গোদাগাড়ীর টমেটো অবদান রাখছে জাতীয় অর্থনীতিতে। রাজশাহীতে শীত মৌসুমে টমেটো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ থাকে সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে কেবল গোদাগাড়ী উপজেলাতেই ২ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হয়। যেখান থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৫ টন টমেটো উৎপাদন হয়। ফলে আমের পর টমেটো এই অঞ্চলে কৃষিবিপ্লব ঘটিয়েছে বলে দাবি করা হয়।
গত মৌসুমে এ উপজেলায় ২ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে টমেটোর চাষ হলেও চলতি বছর গোদাগাড়ী উপজেলায় ২ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হচ্ছে। এখান থেকে অন্তত দেড়শ কোটি টাকার টমেটো কেনা-বেচা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা টমেটো চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। ফলে চলতি মৌসুমে আবাদ বেড়েছে।
কৃষকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, এ অঞ্চলের টমেটো দেশের চাহিদা মেটার পাশাপাশি অর্থনীতিতেও ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। টমেটো চাষ করে এ অঞ্চলের কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক বছর আগেও উন্নত বীজ ও ন্যায্য দাম না পেয়ে টমেটো চাষে কৃষকদের লোকসান গুনতে হয়েছে। ফলে চাষিরা টমেটো চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। তবে গত মৌসুমে আশানুরূপ দাম পাওয়ায় কৃষকরা আবারও তাদের জমিতে টমেটো চাষে ঝুঁকছেন। টমেটো চাষে কৃষি বিভাগের আধুনিক প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, নজরদারি ও বাজারে উন্নত বীজ পাওয়ায় এখন টমেটোর ফলন ভালো হচ্ছে।
তবে কয়েক বছরের তুলনায় সার, বীজ, কীটনাশক ও সেচের দাম বাড়ায় টমেটো চাষের খরচও বেড়েছে। আগে এক বিঘায় টমেটো চাষের খরচ ছিল ১২ হাজার টাকা। এখন ১৮ বা ২০ হাজারের কমে হয় না। এক বিঘায় ৬০ হাজার টাকার টমেটো বীজ বপন করা হলে লাভ থাকবে ৪০ হাজার টাকা।
কৃষকরা জানান, ক্ষেত থেকে টমেটো তোলা যায় আট বার। প্রথম দফায় প্রতি মণ টমেটো বিক্রি হয় এক হাজার ৬শ টাকা থেকে এক হাজার ৮শ টাকায়। পরের তিন দফায় দাম কমে দাঁড়ায় এক হাজারের নিচে।
গোদাগাড়ীর টমেটো চাষি সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, চলতি বছর বিপুল প্লাস, বিপুল, বিগল, হাইটমসহ উচ্চ ফলনশীল উন্নত জাতের টমেটো চাষ করে ফলন ভালে হয়েছে। বাজারের চাহিদা রয়েছে, দামও পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও 'আলোর ফাঁদ' ব্যবহার করে পোকা দমন করা হয়েছে। আমরা ভালো দাম পেয়ে খুশি।
জয় দাস নামে আরেক চাষি জানান, টমেটো পাকার সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকের ক্যারেটজাত করে বাজারে নিয়ে আসতে হয়। কাঁচামাল তাই ঘরে রাখা যায় না। আবার মাঠেও ফেলে রাখা যায় না। ফলে ব্যবসায়ীদের কাছে চাষিরা অনেকটাই জিম্মি। টমেটো সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে হিমাগারের ব্যবস্থা করলে স্থানীয় চাষিরা তাদের ফসলের আরও ভালো দাম পাবেন।
গোদাগাড়ীতে টমেটো কিনতে যাওয়া ঢাকার ব্যবসায়ী বশির সরকার জানান, ১ হাজার ৭শ থেকে ১ হাজার ৮শ টাকা মণ ধরে টমেটো কিনছেন। প্রথম দিকে কেনা টমেটোগুলো প্রক্রিয়াজাত করে হালকা লাল রঙে পরিণত হয়েছে। পুরোপুরি লাল হতে আরও ২-৩ দিন সময় লাগবে। তারপরে বাজারজাত শুরু হবে।
ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন বলেন, টমেটো কেনার পর কয়েক ধাপে বাছাই করতে হয়। বিশেষ করে পোকায় খাওয়া খারাপ টমেটোগুলো ফেলে দিতে হয়। এরপর দাগ হয়ে যাওয়া টমেটোগুলোও বাছাই করতে হয়। এছাড়াও স্প্রেসহ অন্য খরচ মিলে মণপ্রতি অন্তত ১৫০ টাকা খরচ হয়।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ডিডি) শামছুল হক বলেন, ভালো লাভের আশায় কৃষকরা এখন টমেটো চাষ বেশি করছে। কৃষি বিভাগ থেকে আমরা বীজের মান নিয়ে বেশি গুরুত্ব দেই। যাতে কেউ নিম্নমানের টমেটো বীজ নিয়ে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেদিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিচ্ছি। এছাড়া টমেটো চাষের ব্যাপারে কৃষকদের নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি এবছর কৃষকরা ভালো দাম পাবেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০২০
এসএস/এএ