মেহেরপুর: মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস এখন যেন শুধুই হয়রানি আর দুর্নীতির আখড়া। যেখানে ঘুষ, দালাল আর অতিরিক্ত টাকা ছাড়া পাসপোর্ট হাতে পাওয়া যায় না বললেই চলে।
উপ-সহপরিচালক জাকির হোসেনের সহযোগিতায় পাসপোর্ট অফিসের পরিচ্ছন্নতাকর্মী বিপ্লব হোসেন এ দুর্নীতির প্রধান কারিগর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
দীর্ঘ ৯ বছর একই অফিসে চাকরির সুবাদে পরিচ্ছন্নতাকর্মী বিপ্লব পরিণত হয়েছেন 'বিপ্লব স্যারে'। এমনটি জানিয়েছেন পাসপোর্ট করতে আসা কয়েকজন সেবাগ্রহীতা।
সদর উপজেলার আশরাফপুর গ্রামের দুলু হোসেন বলেন, আমার ছেলের পাসপোর্ট করতে দিয়েছি। সকালের দিকে বিপ্লব স্যারের কাছে আবেদন জমাও দিয়েছি। আবার কয়েকদিন পর আসতে হবে। আজকেই ফিঙ্গার করিয়ে দেওয়ার শর্তে তার সঙ্গে দেড় হাজার টাকায় চুক্তি হয়েছে।
একই কথা জানালেন আমঝুপি গ্রামের সোহান নামে আরেক ব্যক্তি। তিনি বলেন, সকালের দিকে বিপ্লব স্যারকে যারা একটু বেশি টাকা দিয়েছেন, তাদের সকাল সকাল ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া হয়ে গেছে। প্রথমে আমি টাকা দিতে চাইনি। কিন্তু এখানকার একজন দালাল জানান যে, বিপ্লবের সঙ্গে চুক্তি না করে হাজার ঘুরেও ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়া হবে না।
গাংনী উপজেলার জিয়া নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, সকালে পাসপোর্টের জন্য আবেদন জমা দিতে এলে অফিসের গেটের এক আনসার সদস্য জানান- ‘এক হাজার টাকা দিয়ে আবেদন জমা দিতে হবে। সেটি না দিলে কোনোভাবেই পাসপোর্ট পাওয়া যাবে না। ’
বুধবার ১০ (আগস্ট) দিনব্যাপী মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ঘুরে অনুসন্ধান করে মিলেছে এমন তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরিচ্ছন্নতাকর্মী বিপ্লব হোসেনের ইশারা ছাড়া পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের আবেদনপত্রের ফাইল নড়ে না। এমনকি তার 'ওকে' লেখা ফাইল দেখলে উপ-সহপরিচালক জাকির হোসেনও তাতে দ্রুত সই করে দেন।
আর পাসপোর্টের জন্য আবেদনের ফাইলে সেই 'ওকে' লেখাতে গুনতে হয় দেড় থেকে ১০ হাজার টাকা। কাজ ভেদে সেটি আবার ৮০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়। এমন অভিযোগ প্রায় সব পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের।
তারা বলেন, নতুন পাসপোর্টের আবেদন করতে দেড় থেকে শুরু করে ৪-৫ হাজার টাকা বেশি নেওয়া হয়। পুরনো পাসপোর্ট রিনিউ করতে লাগে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। আর নাম ও বয়স সংশোধ করতে ৪০ থেকে ৮০ হাজার টাকা অতিরিক্ত নিয়ে থাকেন বিপ্লব হোসেন।
তবে বিপ্লব হোসেন বলেছেন, অতিরিক্ত নেওয়া এসব টাকার ভাগ আমার একার নয়। ঢাকা অফিস পর্যন্ত টাকার ভাগ দিতে হয়।
বিপ্লবের হাত ধরেই প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা ঘুষ আসছে। সব মিলিয়ে মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসটি এখন ঘুষ ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
পাসপোর্ট করতে আসা কয়েকজন আবেদনকারী জানান, যেসব আবেদনপত্রের ফাইলে বিপ্লব হোসেনের দেওয়া 'ওকে' সাইন না থাকে সেগুলো বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ফেরত দেওয়া হয়। সব নিয়ম মেনে আবেদন করেও আবেদনকারীরা মাসের পর মাস ঘুরে ঘুরে পান না পাসপোর্ট।
মেহেরপুর সদর উপজেলার ময়মারি গ্রামের মিয়ারুল ইসলাম নামে এক ভুক্তভোগী জানান, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে পাসপোর্ট রিনিউ করতে দিয়েছি। প্রায় চার মাস ধরে আমাকে বিভিন্ন টেবিলে টেবিলে ঘুরতে হচ্ছে। তাও পাসপোর্ট পাচ্ছি না।
তিনি আরও বলেন, আমি ইজিবাইক চালক। মালেশিয়া যাওয়ার আশায় আমি পাসপোর্ট করতে আসি। এখানে এক অফিসারের রুমে গেলে তিনি বিপ্লবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। বিপ্লবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আবেদনপত্রটি জমা নেন। এর কয়েকদিন পর খোঁজ নিলে তিনি বলেন, পাসপোর্টটি ঠিক করতে ৪০ হাজার টাকা লাগবে। তাকে টাকা দিতে না চাইলে তিনি আমাকে অনেকবার ঘুরিয়েছেন। এ অফিসে ঘুরতে ঘুরতে আমার পায়ের স্যান্ডেল ও জামা ছিড়ে গেছে। কিন্তু আমাকে পাসপোর্টের কোনো তথ্য বিপ্লব স্যার এখনো দেইনি।
গাংনী উপজেলার শিশিরপাড়া গ্রামের মোস্তাক হোসেন নামে আরেক ভুক্তভোগী জানান, তার কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা দাবি করলে তিনি তা দিতে রাজি হননি। অনেক ঘোরানোর পরে অবশেষে বলেছে বিপ্লব বলেছেন, আমি পাসপোর্ট করে না দিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সেটি করে দিতে পারবে না।
মোস্তাক হোসেন নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, চলতি বছরের ১১ এপ্রিল নাম ও জন্ম তারিখ সংশোধন করে পাসপোর্ট রিনিউ করতে দিয়েছি। ওই সময় আমি একটি দেশের ভিসা পেয়েছিলাম। পাসপোর্টের কাজটি জরুরি ভিত্তিত্বে করার জন্য গিয়েছিলাম বিপ্লবের কাছে। তখন তিনি জানতে চান ভিসা করতে কত লেগেছে। আমি সরলভাবে উত্তর দিয়েছিলাম, দেড় লাখ। একথা শুনে তিনি আমাকে বলেন, ওখানে দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন, এই অফিসে আরও ৮০ হাজার টাকা দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, তার দাবি করা সেই টাকা না দেওয়ায় প্রায় ৪ মাস ধরে তিনি আমাকে ঘুরাচ্ছেন। আমি মেহেরপুর পুলিশ সুপারকে (এসপি) জানানোসহ সাংবাদ সম্মেলন করার কথা বললে তিনি ফোনে আমাকে হুমকিও দিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিপ্লব হোসেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে এ পাসপোর্ট অফিসে ২০১৩ সালের ২৮ মে যোগদান করেন। তিনি ১৬ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করেও শহরের অভিজাতপাড়া এলাকার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। দীর্ঘদিন একই অফিসে চাকরি করার সুবাদে পুরো অফিসকেই যেন তিনি জিম্মি করে ফেলেছেন।
জেলা শহরের কলেজ মোড় এলাকায় মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসটির পাশে চার-পাঁচটি কম্পিউটারের দোকান গড়ে উঠেছে। এসব দোকান কেন্দ্র করে আবার স্থানীয় দালাল ও কম্পিউটার মালিকদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালকসহ সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গোপন লেনদেন চলে।
দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সুকৌশলে আদায় করা হয় ঘুষ বাণিজ্যের টাকা। জেলা থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০০-৪০০টি পাসপোর্ট আবেদন জমা হয় এ অফিসে। এগুলো কম্পিউটারের দোকান থেকেই আবেদন করতে হয়। আবেদনের সময় দোকান মালিক ও দালালরা আবেদনকারীদের কাছ থেকে ব্যাংকের নির্ধারিত ফি ছাড়াও অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন।
মেহেরপুর জেলা জজকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী নারগীছ খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, মেহেরপুর পাসপোর্ট অফিসে এসে মানুষ নানাভাবে হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন। এখান থেকে আদালতে প্রতিদিনই প্রচুর পরিমাণ ভুলে ভরা আবেদন অ্যাফিডেভিট করতে পাঠানো হচ্ছে।
মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই মাসে ১ হাজার ৬১৮টি এবং এ মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত ৮৪৭টি পাসপোর্টের আবেদন জমা পড়েছে। এসব আবেদনরে মধ্যে ৩০ শতাংশই রিনিউয়ের আবেদন।
উপ-সহপরিচালক জাকির হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য নিজেই এডিসিকে ফোন দেন। পরে এডিসি তাকে দেখা করতে বলছে জানিয়ে তিনি সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তারপরেও তার কাছে এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিপ্লব হোসেন ভুল করেছেন। তাকে মাফ করে দেন। তার বদলির জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ সময় তিনি সংবাদ সংবাদ না প্রকাশ করার জন্য বার বার অনুরোধ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০২২
এফআর