সিরাজগঞ্জ: জন্ম ভারতের আসাম রাজ্যে হলেও অধ্যাপক আব্দুল মতিন খন্দকারের বাবা-দাদাসহ পূর্ব পুরুষদের শেকড় পোঁতা বাংলাদেশেই। সেই শেকড়ের সন্ধান পেয়ে তিনি চলে এসেছেন বাবার জন্মভূমি বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে।
রোববার (২ অক্টোবর) রাতে তিনি বুড়িমারী সীমান্ত হয়ে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার জগতগাঁতী গ্রামে পৌঁছান। এ সময় তাকে দেখার জন্য শতাধিক আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসী গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। পূর্ব পুরুষের উত্তরসূরির আগমনে স্বজনদের মধ্যে এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সবাই তাকে অভিবাদন জানান।
জানা যায়, ভারতের আসাম রাজ্যের পশ্চিম গোয়ালপাড়া সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল মতিন খন্দকারের পূর্ব পুরুষের জন্মস্থান বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের জগতগাঁতী গ্রামে। তার দাদা মরহুম দেরাজ উদ্দিন খন্দকার বিয়ে করেন তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়ায়। ১৯৪১-৪২ সালে দেরাজ উদ্দিন খন্দকার একমাত্র ছেলে দাইয়ান খন্দকারকে পাঁচ/ছয় বছর বয়সী রেখে মারা যান। এ অবস্থায় শিশু দাইয়ান খন্দকারকে নিয়ে তার মা বাবার বাড়ি আসামে চলে যান। পরে মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেলে দাইয়ান মামাদের কাছে মানুষ হন। সেই দাইয়ান খন্দকারেরই পাঁচ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় আব্দুল মতিন খন্দকার।
আরও পড়ুন: স্বজনদের খোঁজে সিরাজগঞ্জে আসছেন আসামের শিক্ষক
প্রায় নব্বই বছর বয়সী বাবা দাইয়ান খন্দকারের মুখে দেশের বাড়ি জগতগাঁতী, পার্শ্ববর্তী শিবনাথপুর গ্রামের নাম শুনেছেন আব্দুল মতিন। খুব ছোট বয়সে আসামে যাওয়ায় স্পষ্ট করে ঠিকানা বলতে পারতেন না দাইয়ান খন্দকার। এসব বিষয় নিয়ে আব্দুল মতিন কথা বলেন সিরাজগঞ্জের কাজিপুরের সন্তান বর্তমানে আসামে বসবাসরত অধ্যাপক ড. বকশী আহমেদের সঙ্গে। আমিনুল ইসলাম নামে কাজিপুরের একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন বকশী আহমেদ। আর তিনিই যোগাযোগ করিয়ে দেন বাংলানিউজের সাংবাদিক স্বপন চন্দ্র দাসের সঙ্গে। স্বপন চন্দ্র দাস হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে আব্দুল মতিন খন্দকারের সঙ্গে কথা বলে তার পূর্ব পুরুষদের পরিচয় জেনে নেন এবং জগতগাঁতী গ্রামে গিয়ে খুঁজে বের করেন তাদের। এভাবেই প্রায় ৭৫ বছর আগের বিচ্ছিন্ন হওয়া স্বজনদের মিলন ঘটে।
মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) সকালে জগতগাঁতী গ্রামের আব্দুল খালেক খন্দকারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আসাম থেকে বেড়াতে আসা আব্দুল মতিন খন্দকারকে ঘিরে গ্রামের বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের ভিড় জমেছে বাড়িটিতে।
আব্দুল মতিন খন্দকার বলেন, বাবার মুখে জন্মস্থান জগতগাঁতীর কথা শুনেছি। আমার দাদারা তিন ভাই ছিলেন, আবেদ আলী খন্দকার, মাজম আলী খন্দকার এবং দেরাজ উদ্দিন খন্দকার। আমার বাবা দাইয়ান খন্দকার ছিলেন দেরাজ খন্দকারের একমাত্র সন্তান। বাংলাদেশ থেকে আসামে চলে যাওয়ার পর তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। ব্রিটিশ ভারত আমলে দাদা বিয়ে করেছিলেন আসামের গোয়ালপাড়ায়। আমার বাবা দাইয়ান খন্দকার ছিলেন দাদার একমাত্র সন্তান। দাদার অকাল মৃত্যুর পর পাঁচ বছর বয়সে আমার বাবাকে নিয়ে দাদি তার বাবার বাড়ি গোয়ালপাড়ায় আসেন। পরে দাদির অন্যত্র বিয়ে হয়। বাবা দিনমজুরির পাশাপাশি লেখাপড়াও চালিয়ে গেছেন। লেখাপড়া শেষে তিনি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পান। এভাবেই জীবন সংগ্রাম চালিয়ে আমাদের পাঁচ ভাই-বোনকে মানুষ করেছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমার আত্মীয়-স্বজনদের আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বাংলাদেশে আসার পর যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, সবার ব্যবহারেই আমি আপ্লুত হয়ে পড়েছি। এর আগে কারও সঙ্গে দেখা না হলেও মনে হচ্ছে যেন সবাই পরিচিত, সবাই আপনজন।
তার চাচাতো ভাই আলম খন্দকার বলেন, আমরা শুনেছিলাম, আমাদের এক চাচা ভারতে থাকেন। কিন্তু দেখি নাই, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও ছিল না। তার ছেলে আজ আমাদের গ্রামে এসেছেন, অনেক ভালো লাগছে। এখন আমাদের মধ্যে কথা হবে, যাতায়াত হবে।
অপর চাচাতো ভাই আব্দুল খালেক বলেন, সাংবাদিক স্বপন ভাইয়ের মাধ্যমে আমাদের হারানো আত্মীয়কে খুঁজে পেলাম। আমরা সবাই খুব খুশি। সবারই ভালো লাগছে। আত্মীয়-স্বজন আর গ্রামবাসী দলে দলে ভাইকে দেখতে আসছেন।
অবসরপ্রাপ্ত মাদরাসাশিক্ষক ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম কারি আনোয়ার হোসেন বলেন, দাইয়ান খন্দকার খুব ছোটবেলায় ভারতে গিয়েছিলেন। তার বাবা দেরাজ উদ্দিন খন্দকার এ মসজিদে ইমামতিও করেছেন। তখন মসজিদটি ছিল তাদের বাড়িতে। আজ তার বংশধর দেশের মাটিতে ফিরে এসেছেন শুনে আমরা সবাই আনন্দিত।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য (মেম্বর) আশরাফ আলী বলেন, আমরা জানতামও না খোন্দকার পরিবারের কোনো সদস্য ভারতে থাকেন। সেই ব্রিটিশ আমলের ঘটনা, তাই জানাটাও অসম্ভব। তবে পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি জানতেন বলেই আজ আব্দুল মতিন খন্দকারকে সবাই সাদরে গ্রহণ করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০২২
এসআই