ঢাকা, সোমবার, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ রজব ১৪৪৬

রাজনীতি

ট্রমা কাটাতে বিএনপি নেতাকর্মীদের মিলনমেলা 

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫
ট্রমা কাটাতে বিএনপি নেতাকর্মীদের মিলনমেলা  প্রথম ছবিতে তারা বাবু, ডানে ওপরে খাবার পরিবেশন করছেন বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত

যশোর: বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী শাসনামলে নির্যাতিত, নিপীড়িত, হামলা, মামলার শিকার নেতাকর্মীদের নিয়ে যশোরে ব্যতিক্রমী এক মিলনমেলার আয়োজন করেছে বিএনপি।

দলের খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের উদ্যোগে যশোর নগর ও সদর উপজেলা বিএনপি এ মিলনমেলার আয়োজন করে।

 

মিলনমেলায় অংশ নিয়েছিলেন উল্লেখিত সময়ে আওয়ামী লীগের ক্যাডার ও পুলিশের হাতে নিহত নেতাকর্মীদের স্বজনরাও। গত ১৫ বছরে যেসব নেতাকর্মী মারা গেছেন, আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাদের পরিবারের সদস্যদেরও।

অংশ নিয়েছিলেন আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, সমাজসেবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরাও। নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনায় যেসব আইনজীবী সহকারী দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাদেরও দেখা যায় এ মিলনমেলায়। আরও এসেছিলেন মাইককর্মী, পরিবহন শ্রমিকরাও।  

বিগত সরকারের রোষানলে পড়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা যেসব মানুষের বাড়িতে রাতে আশ্রয় নিতেন, সেসব বাড়ির লোকেরাও সামিল হয়েছিলেন এ উৎসবে।  

সব মিলিয়ে নেতাকর্মী আর সাধারণ মানুষের এক মহামিলনমেলায় পরিণত হয় এ উৎসব।

সকাল ১১টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল হতে না হতেই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতাকর্মীরা দলে দলে হাজির হতে থাকেন জেস গার্ডেনে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীদের পেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন সবাই। করমর্দন, কোলাকুলি পর্ব শেষ করে মেতে ওঠেন খোসগল্পে। ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে পুরো পার্কজুড়ে নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে।

স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে মিলনমেলায় দাঁড়িয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন যশোর সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়ন বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক ইউনুস আলী ওরফে তারা বাবু। তার কাছে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে অনুভূতি জানতে চাইলে কেঁদে ফেলেন তিনি।  

দেয়াড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা হলেও তারা বাবুর প্রকৃত বাড়ি শহরতলীর শংকরপুর সন্নাসী দিঘিরপাড়।  

২০১৪ সালের ২৭ মার্চ যশোর কোতোয়ালি থানার তৎকালীন এসআই শোয়েব ও আমির আব্বাস তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান এসপি আনিসুর রহমান কথা বলবেন জানিয়ে। তাকে গাড়িতে উঠিয়ে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ লাইন্সে। সেখানে সিঁড়ির মুখে নিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে পুলিশ। দুই হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডক্যাপে আটকে দেয়। পরে তিনজন পুলিশ তাকে ধরে বাম পায়ে গুলি করে। পরে পুলিশ প্রচার করে তারা বাবু উড়ন্ত ছিনতাইকারী। পুলিশি অভিযানকালে তিনি পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিলেন। পাল্টা গুলি ছুড়লে তার পায়ে লাগে।  

এরপর তারা বাবুকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। সেখানে তিনদিন থাকার পর তাকে আদালতের মাধ্যমে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। কিছুদিন পর জামিনে বের হতে পারলেও তিনি আর পৈত্রিক ভিটাতে থাকতে পারেননি। আশ্রয় নিতে হয়েছে সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নে।

সেখানে থেকেই আমি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থেকেছি। আর ভেবেছি কখন এ জালিম সরকারের পতন হবে-বলেন তারা বাবু।

তারা বাবুর মতো একই অবস্থা মিলনমেলায় আসা প্রায় সব নেতাকর্মীর। তারা বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর পর সব নেতাকর্মীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে মুক্তভাবে কথা বলতে পারছি-এর চেয়ে আর বড় কিছু হতে পারে না। এ আয়োজনের জন্য তারা অনিন্দ্য ইসলাম অমিতকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এভাবে আন্দোলন-সংগ্রামের সাথীদের মূল্যায়ন করা সত্যিই অসাধারণ।

মিলনমেলায় আগতদের আর একজন আশিকুর রহমান। যশোর শহরের এ যুবদল কর্মী বলেন, কতদিন রাজপথের সাথীদের সঙ্গে এভাবে দেখা হয়নি তা বলতে পারবো না। দীর্ঘ সময়ে জালিম সরকার (আওয়ামী লীগ সরকার) আমাদের নেতাকর্মীদের বাড়িতে ঘুমাতে পর্যন্ত দেয়নি। এর-ওর বাড়ি আর বনবাদাড়ে রাত কাটাতে হয়েছে। বাড়ির লোকেরা জানতেনও না তাদের সন্তান বা স্বজন আদৌ বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, নাকি আটক হয়েছেন। সেসব সাথীদের এভাবে এক উৎসবে সামিল করা কল্পনাই করা যায়নি।

মিলনমেলায় সকালে ছিল পুরি, সিঙ্গাড়া, জিলাপি, চা এবং দুপুরে পোলাও, ডাল, রোস্ট, মাংস আর দইয়ের আয়োজন। অনিন্দ্য ইসলাম অমিত নিজে হাতে নেতাকর্মীদের খাইয়েছেন। তদারকি করেছেন পুরো পার্কজুড়ে।

মেলায় খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত টেবিল-চেয়ার থাকলেও জেলাখানায় দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাটানো নেতাকর্মীদের জন্য মাটিতে পাটি পেতে পৃথক ব্যবস্থা করতে হয়েছে। তাদের মধ্যে জয় নামে ছাত্রদলের একজন নেতা বলেন, জেলখানায় তো আর আমাদের চেয়ার-টেবিলে খেতে দেয়নি। অন্ধকার ঘরে কোনোমতে মাটিতে বসে খেয়েছি। মুক্ত আকাশের নিচে মাটিতে বসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে খেতে খেতে জেলখানার সঙ্গে পার্থক্য বুঝতে আমরা এভাবে খেতে চেয়েছি।

বিকেলে মেলামঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কর্মসূচি থাকলেও দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া অসুস্থ থাকায় সেই কর্মসূচি বাতিল করা হয়।  

এসময় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার নেতাকর্মীদের অনেকে অনুভূতি ব্যক্ত করেন। সেসময় এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।  

আয়োজন সম্পর্কে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বাংলানিউজকে বলেন, যশোর সদর উপজেলা ও পৌর এলাকায় দুই হাজার ছয়শ তালিকাভুক্ত নেতাকর্মী রয়েছেন, যারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা ষড়যন্ত্রমূলক মামলার শিকার হয়ে কারাবরণ করেছেন। ১৫ বছরে এ দুই ইউনিটের ১২ জন নেতা শহীদ হয়েছেন। বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন আরও ৫০ জন নেতাকর্মী।  

তিনি বলেন, বিএনপি বিশ্বাস করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সৈনিকদের আত্মত্যাগ আর দীর্ঘ সংগ্রামের ফলেই ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের পতনের পথ সুগম হয়েছে। একে তরান্বিত করেছে সর্বস্তরের শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ। সে কারণে মিলনমেলায় সবাইকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বাদ যাননি বিগত দিনে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার কেউই।  

অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে, কিন্তু, ফ্যাসিবাদ বিলুপ্ত হয়নি। তাদের সমূলে উৎপাটন করে দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে এ সময়ে সবাইকে আরও কঠোরভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।  

নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে এ মিলনমেলা টনিক হিসেবে কাজ করবে বলেও তিনি বিশ্বাস করেন।

মিলনমেলায় আরও উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামী যশোর জেলার আমির অধ্যাপক গোলাম রসুল, যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক নার্গিস বেগম, সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, কেন্দ্রীয় সদস্য ইঞ্জিনিয়ার টিএস আইউব, জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকন, নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এহসানুল হক সেতু ও সদর উপজেলা সাধারণ সম্পাদক আনজুরুল হক খোকনসহ অনেকে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।