ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

কলকাতার ঘাটে ঘাটে

স্মিতা সাহা, কলকাতা থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৫
কলকাতার ঘাটে ঘাটে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা: ১৩ মে ১৯৪১। রাত ৩টা ১৫।

উদয়নে বসে কবিগুরু লিখলেন ‘রূপনারানের কূলে জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়’। মৃত্যুর দেড় মাস আগেও রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন নদী নিয়ে। নদী তার লেখার অন্যতম অনুষঙ্গ। বিশেষ করে শাহজাদপুর থাকাকালীন তার লেখায় বারবার এসেছে নদী, নদীর ঘাট।

নদীপারের ভাঙাগড়া, জীবনের আলেখ্য জীবন্ত হয়ে উঠেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈতমল্ল বর্মণের লেখায়ও। বাংলা সাহিত্যের অনুপ্রেরণায় হঠাৎ হলাম নদীমুখী। ইচ্ছে হলো গঙ্গায় কলকাতার ঘাটগুলো দেখার। প্রথম গন্তব্য কলকাতার আউট্রাম ঘাট। এর একদিকে ‘মিলেনিয়াম পার্ক’ অন্যদিকে তাকালে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা রেসকোর্সের কিছু অংশ।


উনিশ শতকের শেষ লগ্নে নির্মিত এই ঘাট থেকে তৎকালীন পূর্ববাংলা  ও বার্মায় পণ্য যাওয়া-আসা করত। সেই সময়ের এক ব্রিটিশ সেনার নামেই এই ঘাটের নামকরণ করা হয়।

আমাদের পরের গন্তব্য কলকাতার বিখ্যাত বাবু রাজচন্দ্র দাস ঘাট। যেটা ‘বাবুঘাট’ নামে পরিচিত। বাবু রাজচন্দ্র দাস ছিলেন রানী রাসমনির স্বামী। ১৮৩০ সালে রাসমনি এই ঘাট নির্মাণ করেন।

মূলত কলকাতার দুর্গাপূজার সময় প্রতিমা বিসর্জনের জন্য এই ঘাটকে ব্যবহার করা হয়। রানী রাসমনি পাশেই মেয়েদের স্নানের জন্য একটি আলাদা ঘাট নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে সেটি জঞ্জালের স্তূপে পরিণত হয়েছে। বাবুঘাটের একদিকে ইডেন গার্ডেনস স্টেশন অন্যদিকে বড়বাজার। কিছুটা দূরেই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ও কলকাতা উচ্চ আদালত।

বাবুঘাটের তেল মালিশের কথা না বললে অনেকটাই বাদ থেকে যাবে। মাটির উপর টুকরো টুকরো কাঠ জুড়ে একটি খাটের মতন করা। তার উপরে ফেলে চলে তেল মালিশ।

প্রিন্সেপ ঘাট। বাবুঘাটের পাশেই এই ঘাটটি ঘাটের আদলে ব্রিটিশ-ইউরোপীয় স্থাপত্যের প্রভাব দেখা যায়।

জেমস প্রিন্সেপ নামে এক ব্রিটিশ সেনার নামে এই ঘাট নির্মাণ করা হয়েছিল। ইনি পরবর্তীকালে এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক পদে আসীন হন। কলকাতার মানুষদের কাছে এই ঘাটটি একটি অতি পছন্দের ভ্রমণের জায়গা।

কলকাতার আরও এক বিখ্যাত ঘাট আর্মেনিয়ান ঘাট। জানা যায়, আর্মেনিয়ানরাই প্রথম বিদেশি জাতি যারা কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কলকাতার বিখ্যাত পাইকারি ফুলের বাজার এই ঘাট কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।

এখানে হাজির হলেও আপনি দেখা পাবেন বিহার বা ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা মালিশ ওয়ালাদের। পুরুষানুক্রমে এরা ঘাটের ধারে তেল মালিশ করার কাজ করে থাকেন।

মতিলাল শীল ঘাট। হুগলি নদীর উপর এই ঘাট খুব পরিচিত নয়। এই ঘাটের চারিদিকে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু বেআইনি গুদাম ঘর ও ঝুপড়ি। এই ঝুপড়িরই অধিবাসীরা কয়েকজন জানালেন তাদের পূর্বপুরুষরা নাকি রানী রাসমনির কাছ থেকে এই জায়গায় বসবাস করার অধিকার পেয়েছিলেন।

মতিলাল শীল ঘাট গ্রিক–রোমান স্থাপত্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

আমরা হাজির লোহা ঘাটে। যার পোশাকি নাম রাম চন্দ্র গোয়েঙ্কা স্নান ঘাট। এটি কলকাতার এক সময়ের বিখ্যাত ঘাট হলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেল সন্ধ্যের পর অসামাজিক কাজকর্মের নিরাপদ আস্তানা হয়ে ওঠে এই ঘাট।

ঠিক হাওড়া সেতুর তলায় এই ঘাট অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাক্ষ্য বহন করে।

এর পাশেই ছটুলাল ঘাট। চিত্র পরিচালক মীরা নায়ার এই ঘাটেই বিখ্যাত ছবি ‘দ্যা নেমসেক’-এর শুটিং করেছিলেন।

পরের গন্তব্য নিমতলা ঘাট। কিছুটা ভালো হলেও সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মিল আছে লোহা ঘাটের।

কলকাতার বাগবাজার ঘাট এক সময়ে রঘু মিত্রের ঘাট বলে পরিচিত ছিল। জানা যায় ব্রিটিশরা এই ঘাট কলকাতার নাগরিকদের স্নান করার জন্য বানিয়ে দিয়েছিলেন। এর পাশেই মায়ের ঘাট। একে বিচলি ঘাটও বলা হয়।

বাগবাজার ঘাট থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে কুমোরটুলি ঘাট। এই অঞ্চলই কলকাতার প্রতিমা শিল্পীদের বাসস্থান এবং স্টুডিও। এর পাশেই আহেরিটোলা ঘাট। এখানে একটি লঞ্চ ঘাট রয়েছে।

এছাড়াও আমরা হাজির হয়েছিলাম পাথুরিয়া ঘাট, জগন্নাথ ঘাট, হাটখোলা ঘাটে। এই হাটখোলা ঘাট শহরের ইতিহাসের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত। জানা যায়, ১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট জব চার্নক এই ঘাটেই তার নৌকা ভেড়ান।

এছাড়া কলকাতায় আরও বেশ কিছু ঘাট রয়েছে। এদের বেশির ভাগই পরিচর্যার অভাবে মলিন। ঘাটগুলির রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে কলকাতা মিউনিসিপাল করপোরেশন, রাজ্য সরকার পি ডাব্লু ডি ও কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট।
 
ফিরতি পথে  কানে ভেসে এলো কবীর সুমনের সেই চেনা গান প্রথম আলোয় ফেরা, আঁধার পেরিয়ে এসে আমি / অচেনা নদীর স্রোতে চেনা চেনা ঘাট দেখে নামি/ চেনা তবু চেনা নয়, এভাবেই স্রোত বয়ে যায় / খোদার কসম জান, আমি ভালোবেসেছি তোমায়.....।

বাংলাদেশ সময়: ০১২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।