মৌলভীবাজার: শীত এলেই যে বিশেষ এবং ব্যতিক্রমী পিঠাটির কথা মনে আসে তার নাম ‘চুঙ্গা পিঠা’। এটি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ।
শীতের আমেজে উৎসব আর আনন্দের মাত্রা বাড়াতে এ পিঠার জুড়ি নেই। প্রবাসী অধ্যুষিত এ অঞ্চলের প্রবাসীরা শীত মৌসুমে বাড়ি এলে এই পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়। কারণ এই পিঠার ঘ্রাণ, স্বাদ আর ব্যতিক্রমী আয়োজন মন কাড়ে সবার।
এ পিঠা তৈরির উপকরণও অনেকটাই সহজ। উল্লেখযোগ্য উপকরণ মাত্র চার পদ। খড়, বিন্নি চাল ও চালের গুড়া আর বাঁশ। এই চার পদের উপকরণগুলো সংগ্রহ করেই সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয় পিঠা তৈরির কার্যক্রম। বাড়ির আঙ্গিনায় বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি হয় এই চুঙ্গা পিঠা। সব উপকরণ প্রস্তুত হলে ডাক পড়ে পিঠার আয়োজন, পিঠা তৈরি আর খাবার। এসব কাজেই সরব বাড়ির ছোট-বড় সবাই। দলবেঁধে নানা গল্প আড্ডায় আর উৎসব আমেজে অংশ নেন সবাই।
শীতের রাতে খড়ের আগুনে বিশেষ পদ্ধতিতে তাপ দেওয়া হচ্ছে বাঁশের ভেতরে থাকা পিঠার। আর বাড়ির ছোট-বড় সবাই খড় কুটের আগুনের চার পাশে গোল হয়ে শীত তাড়াতে তাপ নেন আগুনের।
বলাই বাহুল্য, এমন একটি বিশেষ পিঠা তৈরির আয়োজনের মধ্য দিয়ে বছরে অন্তত একটি বার আত্মীয়-স্বজনসহ এলাকার সবার সাথে যোগসূত্রতা ও আত্মীয়তার বন্ধন হয় সুদৃঢ়। কিন্তু নানা কারণে এই ঐতিহ্য আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ, চুঙ্গা পিঠা তৈরি করতে যে প্রধান উপকরণটির প্রয়োজন তা আজ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। এই উপকারণটি হারিয়ে যেতে বসেছে প্রকৃতি থেকে। চুঙ্গা পিঠা তৈরির প্রধান উপকারণটির নাম ‘ঢলু বাঁশ’।
তারপরও কোনোমতে ঠিকে আছে হাওর ও পাহাড় ঘেরা এ অঞ্চলের ঐতিহ্য শীতে চুঙ্গা পিঠার রেওয়াজ। শীত এলেই স্থানীয় বাজারগুলোতে এখন মাঝে মাঝে চোখে পড়ে পাহাড়ি ঢলু বাঁশ বিক্রির পসরা। আগেকার দিনের মতো দোকানিরা ঢলু বাঁশের বড় পরিসরের পসরা না বসালেও এবছর অল্প করে হলেও এরকম বাঁশ বিক্রি হচ্ছে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া,জুড়ী বড়লেখা ও কমলগঞ্জের স্থানীয় বাজারগুলোতে।
ঢলু বাঁশ বিক্রেতা রহিম মিয়া জানান, পাহাড়ে আর আগের মতো নেই পিঠা তৈরির ঢলু বাঁশ। বাজারগুলোতে হাতে-গোনা কয়েকজন বিক্রেতা হলেও ক্রেতার সংখ্যা বেশি। তাই বিক্রেতারা পসরা সাজানোর আগেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এসব বাঁশ। আমরা সারাদিন বন থেকে বনে ঘুরে ১০-১৫ আটি (এক আটিতে ২০টি পিঠা তৈরির বাঁশ থাকে) বাঁশ সংগ্রহ করতে হিমশিম খাই। আগে ১ থেকে ২ ঘণ্টায় পাহাড় থেকে ২০টি ঢলু বাঁশ সংগ্রহ করতে পারতেন। এখন নানা কারণে পাহাড়ি বাঁশ, গাছ আর বন উজাড় হওয়ায় তারা মৌসুমেও প্রতিদিন তা বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে বসতে পারি না।
এক কুঁড়ি একই আকার ও আয়তনের বাঁশ (২০টি পিঠা তৈরির বাঁশ) বিক্রি করেন ৫-৭শ টাকা। পৌষ সংক্রান্তির সময় এক কুড়ি ঢলু বাঁশ ৭শ থেকে ৮শ টাকায় আমরা বিক্রি করি বলে জানান এই বাঁশ বিক্রেতা।
চুঙ্গা পিঠা তৈরি প্রসঙ্গে ওই বাঁশ বিক্রেতা বলেন, কলাগাছের কান্ডের দুটি টুকরো অথবা ইট কিংবা মাটি দিয়ে বিশেষ চুলা তৈরি করে তার উপরে বাঁশের চুঙ্গাগুলো সাজিয়ে রাখতে হয়। তারপর খড়ের আগুনে ভালোভাবে চুঙ্গাগুলো পুড়িয়ে নিলেই চুঙ্গাটি পিঠাতে পরিণত হয়। পিঠা তৈরি হয়ে গেলে মোমবাতির মতো সাদা অংশ চুঙ্গার ভেতর থেকে পিঠা আলাদা হয়ে যায়। আগুনে পোড়ানো চুঙ্গাটি ভালো করে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে হাত দিয়ে কিংবা ছুরি দিয়ে আখের ছাল ছাড়ানোর মতো ছিলে নিতে হবে। ছাল ছাড়ানো হয়ে গেলে মিলে কাঙ্ক্ষিত সেই সুগন্ধযুক্ত বাঁশে পিঠা চুঙ্গা।
সিলেট বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জিএম আবু বকর সিদ্দিক বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের জুড়ী উপজেলার কয়েকটি বাঁশবহালে এই প্রজাতির বাঁশ এখনো টিকে আছে। আমরা নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছি ঢলু বাঁশসহ অন্যান্য প্রজাতিগুলোকে টিকিয়ে রাখতে। যাতে কখনোই ওই প্রজাতিগুলো নিশ্চিহ্ন না হয়। তবে আশার কথা হলো, সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চুঙ্গা পিঠার কথা মাথা রেখেই আমরা জুড়ী এবং বড়লেখা উপজেলায় কিছু বাঁশমহলে নতুন করে ঢলু বাঁশের প্লান্টেশন (চাষাবাদ) করেছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২৩
বিবিবি/এএটি