ঢাকা: ঐতিহাসিক ফরায়েজি আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ও তাদের দোসর বশংবদ জমিদার-নীলকরদের আতঙ্ক ছিলেন পীর মুহসীন উদ্দীন আহমদ দুদু মিয়া।
ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পথ নির্দেশনা দানকারী ঐতিহাসিক ফরায়েজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তুল্লাহর সুযোগ্য পুত্র পীর মুহসীনউদ্দীন দুদু মিয়া ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের নিপীড়িত জনগণের আত্মশক্তির বিকাশ এবং ঔপনিবেশিক শক্তি ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের ইতিহাসে দুদু মিয়া ছিলেন এক অন্যতম মহানায়ক।
দুদু মিয়া প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তার যোগ্য পিতা হাজী শরীয়তুল্লাহর কাছে। মাত্র ১২ বছর বয়সে তাকে মক্কায় পাঠানো হয় জ্ঞানার্জনের জন্য। কলকাতা হয়ে মক্কা যাওয়ার সময় তিনি বারাসাতে বাংলার আরেক মহান বীর তিতুমীরের সঙ্গেও দেখা করেন বলে ঐতিহাসিক সূত্রগুলোতে উল্লেখ রয়েছে।
মক্কায় তিনি পাঁচ বছর গভীর অধ্যয়নে ব্যয় করেন। মক্কা থেকে বাড়ি ফিরে আসেন ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে পিতা হাজী শরীয়তুল্লাহর ইন্তেকালের পর ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি।
দুদু মিয়ার অধীনে বাংলা ও আসামের নিপীড়িত জনগণ শক্তিশালী ভ্রাতৃত্ববোধে একতাবদ্ধ হয় ব্রিটিশদের বশংবদ অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে কোনরকম বিদ্রোহ ঘোষণা ছাড়াই দুদু মিয়া বাংলা ও আসামের নিপীড়িত জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সম্পূর্ণ বিকল্প এক আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তখনকার জমিদাররা তাদের প্রভু ইংরেজদের তুষ্ট করে প্রজাদের ওপর নানা নিপীড়নমূলক কর আরোপ করে। দুদু মিয়ার নেতৃত্বে জনগণ এসব নিপীড়নমূলক কর দিতে অস্বীকার করেন।
ঢাকা অঞ্চলে যখন ফরায়েজি আন্দোলন সংখ্যায় ও শক্তিতে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন জমিদার ও নীলকররা ফরায়েজি আন্দোলনকে স্তিমিত করতে নানা অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে।
ফরায়েজি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে রায়তদের আটক ও প্রহার করা ছাড়াও খুঁটির সঙ্গে দাড়ি বেঁধে নাকে মরিচের গুঁড়ো ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। তাদের মাটিতে ফেলে জোর করে ধরে রেখে তাদের নাভির ওপর বিষাক্ত ও ভয়ঙ্কর পোকা ছেড়ে দেওয়া হতো। জমিদাররা দাড়ি রাখার ওপর দাড়িকর ছাড়াও আরও প্রায় ৩০ রকমের অবৈধ কর আরোপ করে। কর দিতে অস্বীকারকারীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।
শরীয়তুল্লাহর ইন্তেকালের পর দুদু মিয়ার নেতৃত্বে জনগণ আরও ব্যাপকভাবে সংগঠিত হন এই অত্যাচার-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে।
১৮৩৮ সালে মক্কা থেকে ফেরার মাত্র এক বছর পর দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে পরগৃহ লুণ্ঠনের মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগকারী ছিল জমিদার, নীলকর এবং তাদের মিত্র সরকারি পুলিশ বাহিনী। এদের মুখপাত্র ছিলেন নীলকর ডানলপ।
কিন্তু তাদের অন্যায় অভিযোগ ফসকে যায়, মুক্তি পান দুদু মিয়া। ১৮৪১ সালে চুচরী নামক এক ব্যক্তিকে খুনের দায়ে দুদু মিয়া ও তার কয়েকজন শিষ্যকে অভিযুক্ত করা হয়।
ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজের বিচারে দুদু মিয়া মুক্তি পান, কিন্তু তার ২২ শিষ্যকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
১৮৪১ সালে কানাইপুর, ১৮৪২ সালে ফরিদপুরে অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে দুদু মিয়ার অনুসারীদের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। নীলকর-জমিদারদের পুঞ্জীভূত আক্রোশ দুদু মিয়া অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা করেন।
তার বিরুদ্ধে এ সময় তৈরি করা হয় নানা কাল্পনিক অভিযোগ। ১৮৪৬ সালে (বাংলা ১২৫৩ সালের ৩০ ভাদ্র) ডানলপের গোমস্তা, জমিদার গঙ্গাপ্রসাদ চৌধুরী, পাঁচচরের গোপীমোহন বাবু ও জগৎ চন্দ্র বাবুর নেতৃত্বে লাঠিয়াল বাহিনী দুদু মিয়ার বাহাদুরপুরের বাড়ি আক্রমণ করে। এসময় তার বেশ কয়েকজন অনুসারীকে হতাহত করে বাড়ির মূল্যবান গৃহসামগ্রী লুণ্ঠন করা হয়।
প্রতিকার চেয়ে আদালতে যান দুদু মিয়া, কিন্তু স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষের কারসাজিতে ফেঁসে যায় মামলাটি। কিন্তু এ অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণে বদ্ধপরিকর হন দুদু মিয়া। কিছু দিনের মধ্যেই কাদির বখশের নেতৃত্বে ডানলপের নীলকুঠি আক্রমণ করেন দুদু মিয়ার অনুসারীরা।
ডানলপ পালিয়ে যান। ধরা পড়েন তার গোমস্তা কাঞ্জীলাল। আদালতে অভিযোগ আনা হয় দুদু মিয়া ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে। দুদু মিয়া ও তার কিছু সংখ্যক হিন্দু ও দেশীয় খৃস্টান অনুচরসহ মোট ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ওই মোকদ্দমায় দুদু মিয়া ও তার সব অনুচর বেকসুর খালাস পান। এর পর থেকে দুদু মিয়া ও তার অনুসারীদের প্রভাব প্রতিপত্তি বহুগুণে বেড়ে যায়।
জমিদার-নীলকররা নানা কূট-কৌশলের আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করলেও তারা ব্যর্থ হয়। দীর্ঘ এক দশক দুদু মিয়া ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে তারা আর দাঁড়াতে পারেনি।
তবে ১৮৫৭ সালে আবার বন্দি হন তিনি। গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে তখন সিপাহি বিদ্রোহের ডামাডোল। জমিদার ও নীলকররা এ সময় সরকারের কান ভারি করে তোল দুদু মিয়া ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে।
তখন সরকার ছিল নাজুক অবস্থায়। ফলে গ্রেপ্তার করা হয় দুদু মিয়াকে। পরে ১৮৫৯ সালে মুক্তি পেলেও অসৎ জমিদারদের উসকানিতে আবার বন্দি হন তিনি।
তার বিরুদ্ধে কোন মামলা না থাকলেও ১৮৬০ সাল পর্যন্ত বন্দি রাখা হয় তাকে। তিনি যখন কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন তখন তার স্বাস্থ্য ভগ্নপ্রায়। মুক্তির অল্পকাল পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
এর পর তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এখানেই ইন্তেকাল করেন তিনি। পুরান ঢাকার ১৩৭ নম্বর বংশাল রোডে কবর দেওয়া হয় তাকে। এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এ মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী।
উল্লেখ্য, উনিশ শতকে ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি জমিদার, নীলকরদের অত্যাচার-শোষণ থেকে কৃষকদের মুক্ত করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০)।
তাঁর এ আন্দোলনই ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ নামে পরিচিত। ফরিদপুরকেন্দ্রিক এ আন্দোলন আশপাশের অঞ্চলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।
আন্দোলনের শুরুর দিকে লক্ষ্য ছিল ‘ধর্মীয় কর্তব্য বাস্তবায়ন’।
আন্দোলনের নামও দেওয়া হয়েছে ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে। ফরায়েজী আন্দোলনের ‘ফরায়েজী’ শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘ফরজ’ (অবশ্য পালনীয়) থেকে। পরে অবশ্য এ আন্দোলনে আর্থ-সামাজিক সংস্কারের বিষয়গুলোও প্রাধান্য পায়।
১৭৯৯ সালে মক্কায় হজ করতে গিয়ে সেখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করে ধর্মীয় শিক্ষায় দীক্ষিত হন শরীয়তুল্লাহ।
১৮১৮ সালে দেশে ফিরে লক্ষ করেন, অনেকেই বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ধর্মীয় রীতিবিরুদ্ধ আচার-অনুষ্ঠান যুক্ত করছে। তিনি এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো পালনের ব্যাপারে মুসলমানদের আহ্বান করেন। একই সঙ্গে ‘শিরক’ ও ‘বিদাত’ নিষিদ্ধের ঘোষণা দেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর তার ছেলে দুদু মিয়া এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০২৪
এসআই