ঢাকা, শুক্রবার, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘দুই শিশুর মামলা আদালতের এখতিয়ারের বাইরে’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২৩
‘দুই শিশুর মামলা আদালতের এখতিয়ারের বাইরে’

ঢাকা: বাংলাদেশের বর্তমান আদালতের এখতিয়ারে নালিশের কারণ উদ্ভব হয়েছে, এমন প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন জাপানি দুই শিশুর বাবা ইমরান শরীফ। তাই তার পক্ষে দায়ের করা মামলা খারিজ করে দিয়েছেন ঢাকার একটি পারিবারিক আদালত।

রোববার (২৯ জানুয়ারি) ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান এ বিষয়ে রায় দেন। রায়ে দুই সন্তানকে জিম্মা চেয়ে বাবা ইমরান শরীফের করা মামলা বিনা খরচায় খারিজ করে দেন। ফলে এই দুই সন্তান মায়ের সঙ্গেই থাকবে বলে জানান আইনজীবীরা।

রায়ে আদালত বলেছেন, যেহেতু বাদী তার নালিশের কারণ আদালতের এখতিয়ারে উদ্ভূত হয়েছে, এটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং বাদী-বিবাদী ও নাবালিকাদের সর্বশেষ বসবাসের স্থান জাপান, সেহেতু পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ধারা ৬ (১) অনুযায়ী এই মোকদ্দমা চলতে পারে না।

জাপানি আদালতে দুই পক্ষের মধ্যে পারিবারিক আদালতে মামলা থাকার কথা উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়েছে, টোকিও পারিবারিক আদালতে মামলা হওয়ার কথা এবং সেই মামলায় প্রথম থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়টি বাদী কর্তৃক স্বীকৃত। অর্থাৎ একটি মোকদ্দমায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারত অবস্থায় মোকদ্দমার বিষয়বস্তুকে সরিয়ে এনে এদেশে এসে বাদী-পিতা পুনরায় একটি মামলা দায়ের করলেন, যা কোনো সাধারণ যৌক্তিক চিন্তায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নাবালিকাদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে এটা নিঃসন্দেহে মারাত্মক ও অনুসরণ অযোগ্য কার্যকলাপ বলে প্রতীয়মান হয়, যা তাদের ভবিষ্যৎ বিকাশে কল্যাণকর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

রায়ে সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, যেখানে ২৫ (২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘মাতৃত্ব এবং শৈশবাবস্থায় প্রতিটি নারী এবং শিশুর বিশেষ যত্ন এবং সাহায্য লাভের অধিকার আছে। বিবাহবন্ধন-বহির্ভূত কিংবা বিবাহবন্ধনজাত সকল শিশু অভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা ভোগ করবে। ’ সেখানে বিবাদী-মাতা সন্তানের প্রাথমিক শুশ্রুষাকারী হওয়া সত্ত্বেও তাকে কিছুই না জানিয়ে ও সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তার কাছ থেকে সন্তানের এভাবে কোনো আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়াই তাদের অভ্যাসগত বাসস্থান থেকে হঠাৎ অন্য একটি দেশে নিয়ে আসা বাদী-পিতার এই বিষয়টি মাতৃত্বের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন রূপটিকে অসম্মান করার নামান্তর। এটি এ কারণেই আলোচনাযোগ্য কেননা, নাবালিকারা কন্যা সন্তান আর এই সামগ্রিক বিষয়টি তাদের স্বীয় আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিকাশের পথে মোটেই মঙ্গলজনক নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়।

মোকদ্দমায় যুক্তিতর্ক শুনে, নথি পর্যালোচনা করে এবং নাবালিকাদের সঙ্গে খাসকামড়ায় একান্তে আলোচনা সাপেক্ষে বাদী-পিতার কাছে হেফাজতে নাবালিকাদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল নিশ্চিত হবে কিনা—এসব আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এই শিশুদের পড়াশোনার ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে আদালত আরও বলেন, জাপানে থাকাকালীন নাবালিকারা উভয়েই পড়াশোনায় খুবই মেধাবী ছিল এবং তাদের ফলাফলও খুব ভালো ছিল। বিবাদী-পিতা তাদের এ দেশে আনার পর তার আরজি অনুযায়ী নবোদয় প্রি-ক্যাডেট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন এবং একই সাথে আমেরিকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আবার জেরায় বলেছেন যে, নবোদয় নয় কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। অর্থাৎ বাদী-বিবাদী আরজি দাখিলের সময় তারা কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন না। এভাবে প্রথম থেকে বিগত ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আসা পর্যন্ত জাপানে পড়াশোনা করা দুটো মেধাবী শিক্ষার্থীকে বাদী-পিতা তার একান্ত চিন্তাভাবনা অনুযায়ী তাদের নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষাপ্রক্রিয়া হতে মুহূর্তেই বিচ্ছিন্ন করার এই সিদ্ধান্ত, নাবালিকাদের কল্যাণের জন্য মোটেই সমীচীন নয় বলে প্রতীয়মান হয়।

আদালত আরও উল্লেখ করেন, মোকদ্দমার রায়ের পর্যায়ে সামগ্রিক আলোচনায় পিতা কিংবা মাতার স্বার্থের উপরে প্রাধান্য পেয়েছে কার হেফাজত ওই নাবালিকাদের জন্য সর্বাধিক মঙ্গলজনক ও নিরাপদ সেই বিষয়টি। এক্ষেত্রে পিতা হিসেবে নাবালিকাদের দেখা সাক্ষাতের পূর্ণ হকদার হলেও বিবাদী-মাতার কাছেই ওই দুই নাবালিকার হেফাজত ও তাদের শারীরিক, মানসিক, পারিপার্শ্বিক তথা সার্বিকভাবে মঙ্গলজনক মর্মে প্রতীয়মান হয়। সার্বিক বিবেচনায়, বাদীর হেফাজতে নাবালিকা কন্যাদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল নিশ্চিত হবে মর্মে বাদী-পিতার এই দাবি বাদীপক্ষ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন বিধায় আলোচ্য বিষয়টি বাদীর প্রতিকূলে নিষ্পত্তি করা হলো।

রায়ের সময় এক সন্তান জেসমিন মালিকা তার মা জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকোর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। তবে বাবা ইমরান শরীফের সঙ্গে থাকা অপর নাবালিকা সন্তান লাইলা লিনাকে নিয়ে তিনি হাজির হননি। রায়ের পর জেসমিন মালিকা বলেন, বাবাকে আমরা ভালোবাসলেও আমরা মায়ের সঙ্গেই থাকতে চাই। বাবা আমাদের সঙ্গে যখন দেখা করতে চাইবেন, আমরা অবশ্যই তার সঙ্গে দেখা করব।

অপরদিকে রায়ে সংক্ষুব্ধ বলে জানান বাদীপক্ষের আইনজীবী নাসিমা আক্তার লাভলী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাদীর সঙ্গে বিবাহের সময় বিবাদী ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছিলেন। সুতরাং তাদের বিবাহ মুসলিম রীতিনীতি মেনেই হয়েছে। তাই আইন অনুযায়ী তাদের সন্তান মুসলিম হবে। কিন্তু জাপানে তার মায়ের তত্ত্বাবধানে এই সন্তানদের মুসলিম রীতি-নীতি মেনে লালন-পালন করার মতো পরিবেশ নাই। এছাড়াও আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণে যেসব দলিল উপস্থাপন করেছি এবং যেসব নজির দিয়েছি, তার কোনো পর্যালোচনা এই রায়ে উল্লেখ করা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবো। আপিল বিচারের ধারাবাহিকতা। তাই আপিল নিষ্পত্তির পরই সিদ্ধান্ত হবে সন্তানরা কাদের সঙ্গে থাকবে।

বাংলাদেশ সময়: ২০১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২৩
কেআই/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।