ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

দৈনিক পত্রদূত সম্পাদক আলাউদ্দিন হত্যা: বিচার শেষ হয়নি ২৬ বছরেও

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৪ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০২২
দৈনিক পত্রদূত সম্পাদক আলাউদ্দিন হত্যা: বিচার শেষ হয়নি ২৬ বছরেও

সাতক্ষীরা: ১৯ জুন, ১৯৯৬। এ দিন রাত ১০টা ২৩ মিনিটে নিজ পত্রিকা অফিসে কর্মরত অবস্থায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে নির্মমভাবে খুন হন দৈনিক পত্রদূত সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা স. ম. আলাউদ্দিন।

এ হত্যার পর ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি সাতক্ষীরার দৈনিক পত্রদূত সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা স. ম. আলাউদ্দীন হত্যা মামলার বিচার।  

এ ২৬ বছরের মধ্যে প্রায় ২০ বছর মামলাটির আসামিপক্ষ এবং রাষ্ট্রপক্ষের বিভিন্ন আবেদনের কারণে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত ছিল। এর মধ্যে গত ২০১৮ সালের শেষের দিকে বাদী পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত হয়। পরে করোনা পরিস্থিতির কারণে এবং উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের আবেদনের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া বন্ধই আছে।

এছাড়া আসামিপক্ষের কোয়াশমেন্ট এবং আদালত পরিবর্তনের আবেদনের কারণে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও অ্যাপিলেট বিভাগের আদেশে মামলার বিচার প্রক্রিয়া আরও প্রায় ১৫ বছর বন্ধ ছিল।

আলাউদ্দীন সাতক্ষীরার দৈনিক পত্রদূতের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি ১৯৭০ এর নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন সে সময়কার সর্বকনিষ্ঠ (১৯৪৫ সালের ২১ আগস্ট জন্ম গ্রহণ করেন) প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য।

১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, ৬৮’র গণআন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন আলাউদ্দীন। মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে সরাসরি অস্ত্র হাতে যে ক’জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য যুদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেও। তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

স. ম. আলাউদ্দীন সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সের প্রতিষ্ঠাতা এবং পরে আমৃত্যু সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯২ সালে সাতক্ষীরা জেলায় তারই নেতৃত্বে প্রথম বঙ্গবন্ধুর নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বঙ্গবন্ধু পেশাভিত্তিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ) গড়ে তোলা হয়। তিনি ছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ।

সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। এছাড়া অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং পড়ালেখার সঙ্গে নিয়মিত যোগসূত্র থাকা একজন রাজনীতিক ছিলেন তিনি।

১৯৯৬ সালের ১৯ জুন দৈনিক পত্রদূত অফিসে কর্মরত থাকা অবস্থায় স. ম. আলাউদ্দীনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই দিন রাতে তার মেজ ভাই স. ম. নাছির উদ্দিন (বর্তমানে মৃত) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পাঁচদিন পর মামলার অন্যতম আসামি সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর এলাকার কাজী সাইফুল ইসলাম গ্রেফতার হন। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দোষ স্বীকার করেন তিনি। হত্যাকাণ্ডের কারণ এবং অন্যান্য আসামিদের নাম ঠিকানাও প্রকাশ করেন।

১১ মাস পর ১৯৯৭ সালের মে মাসে সিআইডি ১০ জনকে আসামি শ্রেণিভুক্ত করে এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আসামিরা হলেন আলিপুরের আব্দুস সবুর, সুলতানপুরের খলিলুল্লাহ ঝড়ু, তার ভাই মোমিন উল্লাহ মোহন, তার আর এক ভাই সাইফুল্লাহ কিসলু, তালা উপজেলার নগরঘাটার আব্দুর রউফ, তার শ্যালক শহরের কামালনগরের আবুল কালাম, সুলতানপুরের এসকেনদার মির্জা, কাজী সাইফুল ইসলাম, প্রাণসায়রের শফিউল ইসলাম শফি ও আতিয়ার রহমান। আসামিদের মধ্যে সাইফুল্লাহ কিসলু মারা গেছেন এবং আতিয়ার রহমান প্রথম থেকেই পালাতক।

চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের প্রায় এক বছর পর আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়। এ আদেশের বিরুদ্ধে কয়েকজন আসামি উচ্চ আদালতে কোয়াশমেন্টের আবেদন করেন। স্থগিত হয় মামলার বিচার কার্যক্রম। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৯৯৯ সালের ২৬ জুলাই মামলার প্রভাবশালী আসামি আব্দুস সবুর, খলিলুল্লাহ ঝড়ুসহ কয়েকজন সাতক্ষীরা দায়রা জজ আদালতে জামিনের আবেদন করেন। আদালত তাদের আবেদন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর আদেশ দেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আসামিদের আজ্ঞাবহ সন্ত্রাসীরা সাতক্ষীরা আদালত ঘেরাও করেন এবং বিচারকদের জিম্মি করেন। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা পর ওই দিন রাত ৮টার দিকে বিভিন্ন জাতীয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এ খবর প্রচার হলে খুলনা-যশোর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এলে সন্ত্রাসীরা সরে যান। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা বিচারকদের জিম্মি করে রাখা হলেও সেদিন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা হাতে গোনা একশ’ থেকে দেড়শ’ সন্ত্রাসীকে সরিয়ে দিতে কোনো উদ্যোগ নেননি। বরং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিচারকের খাস কামরায় হাজির হয়ে সে সময়ের জেলা ও দায়রা জজকে চাপ দেওয়া দেন আসামিদের জামিন দিতে। যদিও সাতক্ষীরা দায়রা জজ আদালত প্রকাশ্য আদালতে দেওয়া আদেশ পরিবর্তন করেননি। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই আসামিরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে যান। এ ঘটনার কিছুদিন পর সবুর ঝড়ুসহ মামলার চারজন আসামি হাইকোর্টে কোয়াশমেন্টের আবেদন করলে আদালত সে আবেদন মঞ্জুর করেন। রাষ্ট্রপক্ষ কোয়াশমেন্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে অ্যাপিলেট ডিভিশনে আপিল করে। ২০০০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির এক অনুষ্ঠানে বিচার বিভাগের তৎকালীন দূরাবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে এ মামলার কথা উল্লেখ না করেই বলেছিলেন, আমার আইন পেশা ও বিচারিক জীবনে হত্যা মামলায় কোয়াশমেন্ট হয়, তা কখনো দেখিনি। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে ওই কোয়াশমেন্টের আদেশ খারিজ হয়। কিন্তু সেই আদেশ সাতক্ষীরা আদালতে পৌঁছাতে সময় লাগে কয়েক বছর। পরে সাতক্ষীরা দায়রা জজ আদালতে মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হলে আসামিরা আদালত পরিবর্তনের আর্জি নিয়ে হাইকোর্টে যান। সাতক্ষীরায় ন্যায়বিচার পাবেন না- কারণ দেখিয়ে তারা আবেদন করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে সে আবেদনও নামঞ্জুর হয়। আসামিরা ওই আদেশের বিরুদ্ধে যান অ্যাপিলেট ডিভিশনে। সেখানেও দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে আসামিদের আবেদন খারিজ হয়। এভাবেই কেটে যায় প্রায় ১৫টি বছর।

অবশেষে সব বাধা পেরিয়ে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ২০১১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। পরপর কয়েকজনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর নতুন করে শুরু হয় সাক্ষীদের প্রতি হুমকি-ধামকি। আদালত প্রাঙ্গণে নিহতের জ্যেষ্ঠ কন্যাকেও প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় থানায় জিডি হয়। আদালতের নির্দেশে ওই জিডির তদন্ত হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। তবে তাতে আসামিদের জামিন বাতিল হয়নি। এরই মধ্যে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার ৩৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৩ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।

এদিকে মামলার অন্যতম সাক্ষী নিহত স. ম. আলাউদ্দিনের স্ত্রী লুৎফুন্নেছা বেগম সাক্ষ্য দেন ২০১৮ সালের ২১ মে। কিন্তু অভিযোগ ওঠে সাক্ষীর জবানবন্দি যথাযথভাবে আদালতের নথিতে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। এছাড়া এ মামলা সম্পর্কে বিচারকের ব্যক্তিগত আগ্রহসহ বিভিন্ন অভিযোগে বাদী পক্ষ থেকে বিচারক পরিবর্তন করার জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়। ফলে আবার মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। করোনা পরিস্থিতিসহ নানা কারণে এর মধ্যে কেটে গেছে আরও প্রায় সাড়ে তিন বছর।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০২ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।