ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ ভাদ্র ১৪৩১, ৩০ আগস্ট ২০২৪, ২৪ সফর ১৪৪৬

জাতীয়

আদা চাষে এক মৌসুমে ৩ কোটি টাকা লাভের আশা কৃষকের

মো. জাহিদ হাসান জিহাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০২৪
আদা চাষে এক মৌসুমে ৩ কোটি টাকা লাভের আশা কৃষকের

কুষ্টিয়া: বাণিজ্যিকভাবে বস্তায় আদা চাষ করে সাড়া ফেলেছেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের চর বহুলা গ্রামের বাবুল হোসেন।  

গতানুগতিক চাষাবাদের বাইরে তিনি এবার ফল বাগানের মধ্যে বস্তায় আদা চাষ করেছেন, যা ওই এলাকায় একদমই নতুন।

তার আদা ক্ষেত দেখাশোনা এবং পরিচর্যা করার জন্য গ্রামের চার-পাঁচজন কৃষক এবং সাত-আটজন নারী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। প্রথমবারেই তিনি প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার আদা বিক্রি করতে পারবেন বলে মনে করেন।

কৃষিজমি ব্যবহার না করে বাবুল হোসেন তার নয় বিঘা ফল বাগানের মধ্যে ৬০ হাজার বস্তা “বারি আদা-২” জাতের আদার চাষ করেছেন।

মশলা জাতীয় ফসলের মধ্যে আদা খুবই পরিচিত একটি ফসল। যা খাবারের স্বাদ বাড়াতে সাহায্য করে। অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সম্পন্ন আদা নানা ধরনের রোগ যেমন জ্বর, সর্দি, কাশি নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আদা একটি বহুবর্ষীয় ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। আদা চাষ মাটি এবং বস্তায় দু’রকমভাবেই করা যায়। বস্তায় আদা চাষ খুব লাভজনক, যা সহজেই করা যায় বলে জানায় কৃষি কর্মকর্তারা।

সরেজমিনে কুমারখালীর বাবুল হোসেনের আদার জমিতে গিয়ে দেখা যায়, লিচু, মেহগনি, কলাসহ বিভিন্ন বড় গাছের মধ্যে সিমেন্টের বস্তায় সারি করে সাজানো আদার বস্তা। কয়েকজন শ্রমিক সেখানে পরিচর্যা করছেন। পাঁচ-ছয়জন নারীকে দেখা যায় হাত দিয়ে বস্তায় সার দিচ্ছেন, সঙ্গে পুরুষেরা আদার পরিচর্যায় ব্যস্ত। বস্তাগুলোকে বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন তারা। যা দেখলে যে কারো মন জুড়িয়ে যায়। পুরো বাগান দেখাশোনার কাজ করেন ওই এলাকার আরেকজন কৃষক সাদ্দীন শেখ। বাবুল হোসেন ব্যবসায়ী কাজে বেশিরভাগ সময় ঢাকাতে অবস্থান করায় আদার চাষ দেখাশোনা করেন সাদ্দীন শেখ।

সাদ্দীন শেখ বাংলানিউজকে জানান, লিচু বাগানের মধ্যে তো অন্য ফসল করা যায় না। তবে আদা-কিংবা হলুদ হয়। কিন্তু ভালোভাবে চাষ করার ঝামেলা, বৃষ্টি-খরায় ঠিকমতো হয় না। তাই উপজেলা কৃষি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বস্তায় আদা চাষের পরামর্শ দেয়। কিন্তু বস্তায় কীভাবে আদা চাষ করতে হয় সেটা জানতাম না। পরে বাবুল হোসেনসহ আমরা কয়েকজন উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তিনদিনের একটা প্রশিক্ষক নিলাম। সেখানে কীভাবে বস্তায় আদা চাষ করে, কীভাবে পরিচর্যা করে সেটা সম্পর্কে ভালো ভাবে জানলাম। ট্রেনিং থেকে আমরা বস্তায় আদা চাষের জন্য আগ্রহী হওয়ার পরে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় একটা প্রদর্শনী দেয়। প্রদর্শনীতে ১০০ বস্তা আদা চাষের জন্য সহায়তা করে। কিন্তু বাবুল হোসেন একবারে ৬০ হাজার বস্তা আদা চাষ করার পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করেন।

তিনি জানান, এত বস্তা আদা যদি মাঠের জমিতে করা হয় তাহলে ওই জমিতে তো অন্য কিছু এক বছর চাষ করা যাবে না। তাই আমরা এই বাগানের মধ্যে শুরু করলাম। এখানে এই বস্তায় আদা চাষ যেহেতু নতুন তাই এলাকাসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষ এই আদা কীভাবে চাষ করে দেখতে আসে। সেই সঙ্গে এক-দুই বস্তা করে বাড়িতে করার জন্য আগ্রহ দেখায়।

বস্তায় আদা চাষ সম্পর্কে তিনি বলেন, মাটির তুলনায় বস্তায় আদা চাষ করা লাভজনক। কারণ বস্তায় জমি চাষ করা লাগে না, রোগবালাই কম হয়, আদা সংগ্রহ সুবিধা, আদার ফলন বেশি সেইসঙ্গে যেকোনো সময় বস্তা সরানো যায়। তাছাড়া বস্তায় আদা চাষ করলে মাটির চেয়ে তিনগুণ ফলন পাওয়া যায়।

তিনি আরও বলেন, যেকোনো পরিত্যক্ত জায়গা, বসতবাড়ির চারদিকে ফাঁকা জায়গা, লবণাক্ত এলাকা, বাড়ির ছাদে, স্থায়ী ফল বাগানের ছায়াযুক্ত স্থানে, সহজেই চাষ করা যায়। একই জায়গায় বারবার চাষ করা যায়। প্রতি বস্তায় ২০-২৫ টাকা খরচ করে এক-তিন কেজি আদা পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, বস্তায় আদা চাষ করার কারণে অনেক শ্রমিক এখানে কাজের সুযোগ পেয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে। আশা করছি খরচের পাঁচ গুণ লাভ পাবো। সাড়ে তিন কোটি টাকার মতো আদা বিক্রির আশা করছি।  

স্থানীয় কৃষক ইউসুফ আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমি ৩০ বছর ধরে চাষাবাদ করি। আদা চাষ দেখেছি মাটিতে জমি চষে চাষ করতে। কিন্তু এবার এখানে দেখছি বস্তায় আদার চাষ করেছে। যদি ভালো ফলন হয় তাহলে এলাকার অনেকেই বস্তায় আদার চাষ করবে।

কৃষক সাইদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, বস্তায় আদা চাষ শুনছি লাভজনক। আমাদের এলাকায় যেহেতু করছে, নিজের চোখে দেখছি। যদি ভালো হয় তাহলে আমরাও আগামীতে বস্তায় আদা চাষ করবো। যেহেতু বস্তা যেকোনো জায়গায় সরানো যায়, আবার প্রতিগাছে সার ঠিকমতো দেওয়া যায় এটা সুবিধা আছে। মাটির তুলনায় বস্তায় ফলনও ভালো হবে সবাই বলছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য মতে, জেলায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ হেক্টর জমিতে আদার চাষ হয়েছিল। এ বছর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সেটি বেড়ে ৮ হেক্টর হয়েছে। এছাড়া কৃষকরা বসতবাড়ির আশপাশে, ফলবাগানে, পতিত জমিতে বস্তায় আদা চাষ করছেন।

কুমারখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ কুমার দাস জানান, আমরা কৃষি অফিসের মাধ্যমে কৃষকদের বস্তায় আদা চাষের ওপর প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিচ্ছি। সেইসঙ্গে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা প্রদর্শনী স্থাপন করছি যাতে কৃষকরা বস্তায় আদা চাষে আরও আগ্রহী হয়।

পতিত জমির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং আধুনিক উপায়ে আদার উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে লাভজনক করার জন্য যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প বস্তায় আদা চাষের ওপরে গুরুত্ব দিয়ে যশোর অঞ্চলের ৩১টি উপজেলায় প্রদর্শনী স্থাপন করেছে। এর মাধ্যমে কৃষকরা হাতে কলমে বস্তায় আদা চাষ শিখছেন এবং নিজ নিজ বাড়িতে বস্তায় আদা চাষ করছেন বলে জানান প্রকল্প পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষ।

তিনি জানান, কৃষিকে লাভজনক ও আধুনিক করতে নতুন কৃষি প্রযুক্তি আমরা কৃষক পর্যায়ে প্রদর্শনী আকারে স্থাপন করেছি। বস্তায় আদা চাষটা মাটিতে চাষাবাদের তুলনায় লাভজনক ও নতুন প্রযুক্তি। তাই এটি আমরা সম্প্রসারণে কাজ করছি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুফি মো. রফিকুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, আদা একটি মসলা জাতীয় ফসল এবং এর বাজার দর সব সময়ই ভালো। বাণিজ্যিকভাবে আদা চাষ করে অনেকেই লাভবান হয়েছেন। আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে আদার উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে বস্তায় আদা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। যাতে কম খরচে কৃষক বেশি ফলন পেতে পারে। এজন্য আমরা সার্বক্ষনিক কৃষকদের সহযোগিতা করছি।

বাংলাদেশ সময়: ১১২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০২৪
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।