ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ ভাদ্র ১৪৩১, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৮ সফর ১৪৪৬

জাতীয়

রোগী-চিকিৎসকের আস্থাহীনতার সংকট: সমাধান কোন পথে?

রেজাউল করিম রাজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৪
রোগী-চিকিৎসকের আস্থাহীনতার সংকট: সমাধান কোন পথে?

ঢাকা: বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজির (বিইউবিটি) শিক্ষার্থী ছিলেন আহসানুল হক দীপ্ত। গত শনিবার (৩১ আগস্ট) সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

এরপর দীপ্তর পরিবার ও বিইউবিটির শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেলে আসেন। তারা দাবি করেন, অবহেলার কারণে দীপ্ত মারা গেছেন। এটিকে কেন্দ্র করে মৃতের বন্ধুরা ঢামেকের একটি অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে চিকিৎসকদের মারপিট করেন। এতে আহত হন নিউরো সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ইমরান, মাশরাফি ও জুবায়ের।

এ ঘটনার পর গত রোববার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকেই জরুরি ও বহির্বিভাগের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে কর্মবিরতিতে যান চিকিৎসকরা।

একইদিন আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় ৫১ বছর বয়সী এনামুল হক রিটন নামে এক কিডনি রোগীর মৃত্যু হয়। স্বজনদের অভিযোগ, অর্থের লোভে তড়িঘড়ি করে অপারেশন করাতে গিয়ে রোগীকে ভুল চিকিৎসা দিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসক আবিদ হোসাইন। ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক।

স্বজনদের অভিযোগ, ডা. আবিদ গত রোববার দ্রুত অপারেশনের কথা জানিয়ে রাত ১১টায় অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন। তবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সন্ধ্যা ৬টায় রোগীকে ওটিতে নিয়ে অপারেশন করেন ডা. আবিদ। কিছুক্ষণ পর অবস্থার অবনতি হলে এনামুলকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) রেখে পালিয়ে যান। পরে তাকে মৃত অবস্থায় পান আইসিইউর দায়িত্বরত চিকিৎসকরা।

এ ঘটনা দুটির মতো সারাদেশেই এমন ঘটনার খবর নিয়মিত সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এসব ঘটনায় রোগী কিংবা রোগীর স্বজনেরা ভুল চিকিৎসার অভিযোগ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের মারধর কিংবা লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়।

চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে চরম আস্থাহীনতার সংকট রয়েছে। এ সংকট দূর করতে একটি ভারসাম্যমূলক স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা আইন প্রণয়ন কিংবা স্বাস্থ্য খাতের প্রকৃত জনবান্ধব সংস্কার করা জরুরি। যেখানে, সেবাগ্রহীতা বা রোগী, সেবাদাতা চিকিৎসক ও চিকিৎসা টিম এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের অধিকার ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা হবে।

কোনো পক্ষের অধিকার রক্ষিত না হলে অথবা কোনো পক্ষ দায়িত্ব পালন না করলে আইনের দ্বারা সেটি সমাধানের সহজলভ্য ব্যবস্থা থাকবে। পৃথিবীর সব সভ্য দেশে এ ধরণের আইন রয়েছে। কিন্তু বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশে এরকম একটি জন-গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন বা সংস্কার কোনো সরকার করতে সমর্থ হয়নি। যে কারণেই রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে এমন সংকট বাড়ছে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসাবিজ্ঞানী, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সের (বিইউএইচএস) প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বাংলানিউজকে বলেন, চিকিৎসাগ্রহীতা এবং চিকিৎসা প্রদানকারীর অধিকার বলে এক ধরনের চার্টার মন্ত্রণালয়ে আছে, যেটা সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে দৃশ্যমান স্থানে টাঙিয়ে রাখার কথা। কিন্তু কখনো তা হয়নি। স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনও অত্যন্ত জরুরি। তবে আইনটা প্রণয়ন হয়নি। কারণ, আইন যারা প্রণয়ন করবেন, তারাই আবার দেখা যাচ্ছে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর মালিক, ধারক বাহক। এই জটিলতার ফলে কোনো রকম জনমুখী আইন যেটা জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে, তা আর হয়ে ওঠেনি। এমনকি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মূল্য নির্ধারণের বিষয়টাও করা সম্ভব হয়নি।

তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্যসেবার পাবলিক সেক্টর অবহেলিত হতে হতে ৭০ শতাংশ সেবাই প্রাইভেট সেক্টরে চলে গিয়েছে। তখন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনের মতো এমন আইন পাশ করা খুব কঠিন হয়ে যায়। তখন চিকিৎসকেরাও এই বেসরকারি ব্যবসায় একটি অংশীদার হয়ে যায়। পাশাপাশি যারা সেবা গ্রহীতা (রোগী) তাদের মধ্যেও অসহিষ্ণুতা এবং মাস্তানি করার প্রবণতা বেড়ে যায়। একই লোক দেখবেন বিদেশে গিয়ে লাইনে দাড়িয়ে চিকিৎসা বা অন্যান্য সেবা গ্রহণ করছেন। কিন্তু দেশে সেই লোকই একটু অপেক্ষা করতে চান না। কারণ, সে কোনো না কোনো শক্তির সঙ্গে জড়িত। এসব মানসিকতা পরিহার করতে প্রথমত আইন লাগবে, সেটা জনমূখী আইনে সংস্কার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেবা গ্রহীতা এবং দাতা একে অপরের শত্রু না বরং বন্ধু সেই প্রচার প্রচারণাও করতে হবে। একইসাথে চিকিৎসার প্রয়োজনীয় জনবল ও উপকরণ দিতে হবে।

এ চিকিৎসা বিজ্ঞানী আরও বলেন, স্বাস্থ্য শিক্ষায় নৈতিকতার শিক্ষা, রোগীর সাথে ব্যবহারের শিক্ষা, এসব বিষয় কারিকুলামে যুক্ত করতে হবে। ভালো ডাক্তারের সাথে ভালো ব্যবস্থাপক তৈরিতেও গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পুরোপুরি সংস্কার ছাড়া সহজে এইসব বিষয় সমাধানযোগ্য নয়।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি এবং স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, রোগীর সাথে চিকিৎসকের সম্পর্ক চিকিৎসা দেওয়া, সেখানে সুরক্ষার প্রশ্ন আসে কেন? রোগীর বিশ্বাস, ডাক্তার তাকে সঠিক চিকিৎসা দেবে। সুরক্ষার সাথে যুক্ত নিষ্ঠা। ডাক্তার এবং রোগীর যে ভুল বোঝাবুঝি এখানে সুরক্ষার বিষয় একটাই, চিকিৎসক সঠিক চিকিৎসা দিচ্ছে কি না এবং রোগী চিকিৎসায় সন্তুষ্ট হচ্ছে কি না।

তিনি বলেন, এখানে কোথায় ঘাটতি হচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি চিকিৎসা বিষয়ে অসন্তুষ্ট হয়, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারে। নৈতিকতা সংক্রান্ত অভিযোগ বিএমডিসিতে করা যায়। এরপরেও আপনি যদি খুশি না হন দেশের আইনেও যেতে পারেন। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসক কাউকে ইচ্ছা করে যদি ভুল চিকিৎসা দেয়, সেটা যদি আপনি প্রমাণ করতে পারেন সেটা হলো তার অবহেলা। এতে রোগীর ক্ষতি হলে আপনি আদালতে যেতে পারেন। সারা বিশ্বের সব জায়গায় এভাবেই চলে স্বাস্থ্যসেবা।

অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব আরও বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় জটিলতা কোথায় তৈরি হচ্ছে সেটা দেখতে হবে। সরকারি স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বাজেট নাই, হাসপাতালগুলো অপরিছন্ন, অনেক লোকের সমাগম, ভদ্রলোকেরা সেখানে গিয়ে বিপদে পড়ে যায়। প্রাইভেট সেক্টরে সেবার মূল্য অনেক বেশি। আবার রোগী মারা গেলে টাকা দিতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক। এসব হচ্ছে সমস্যা। চিকিৎসকদের বুঝতে হবে রোগী আসলে তাকে কোন ভাষায় বোঝাতে হবে। রোগী ডাক্তারের কাছে আসে ভালো হতে, কিন্তু সব রোগতো আর ভালো হবে না। তাই রোগীদের সেইভাবেই বোঝাতে হবে। এখন ডাক্তারদের মারলে বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করলে আইনের আশ্রয় নিতে পারে। আইনের ঘাটতি আমি দেখি না।

গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, আপনারা (সাংবাদিকরা) এটা বের করতে পারেন ডাক্তারের অবহেলা কোন কোন জায়গায় আছে, সেগুলো তাদের বলা। আবার জনগণকে বলা চিকিৎসক ইচ্ছা করে কোনো সময় রোগীকে মারে না। কাউকে মারা ডাক্তারের দায়িত্ব না, তবে রোগীরাভাবে ডাক্তার মেরে ফেলছে। পৃথিবীর কোথাও ডাক্তারদের সুরক্ষার জন্য আইন করা হয় না।

স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার প্রয়োজন আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা স্বাস্থ্যখাতকে ডি-সেন্ট্রালাইজের কথা বলেছেন। আবার স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেছেন, এটা তাড়াতাড়ি সম্ভব না, সময় লাগবে। আমি বলি স্বাস্থ্য নিয়ে যারা চিন্তা করে তারা দরিদ্র মানুষ, তাদের কথা কেউ শুনবে না। আর যাদের সংগতি আছে তাদের বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। আমি গত ৪০ বছর ধরে একি কথা বলছি, কিন্তু কেউ শোনে না। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের কিছু পরিবর্তন ডোনারদের পয়সা এবং তাদের কথায় হয়। নেতা এবং আমলারা তাদের নিজেদের স্বার্থে কিছু অবকাঠামোর উন্নয়ন করে টাকা পয়সা কামানোর জন্য। এই জন্যে স্বাস্থ্যসেবায় বাজেট কম, ম্যানেজম্যান্টে দক্ষ লোক তারা তৈরি করছে না। সুতরাং স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি স্থানে সমস্যা আছে। এসব বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার।  

স্বাস্থ্যখাতের সংস্কার প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম গণমাধ্যমে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার তাড়াতাড়ি সম্ভব না, তড়িঘড়ি করে করা যাবে না, উচিতও না। প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য নীতিমালা করতে হবে। চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ বহু ধরনের কর্মকর্তা, কর্মচারী রয়েছেন। আছে নানা স্তরের শিক্ষা ও সেবা প্রতিষ্ঠানও। সংস্কার হতে হবে সবার জন্য, সব প্রতিষ্ঠানের জন্য। কাজটি করার জন্য বিশেষজ্ঞদের দরকার, আমি বিশেষজ্ঞদের কমিটি দিয়ে কাজটি করাতে চাই। এ রকম একটি কমিটি ইতিমধ্যে গঠন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য কমিশন করার মতো চিন্তা আপাতত নেই।

বাংলাদেশ সময়: ১০০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২, ২০২৪
আরকেআর/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।