ঢাকা, শনিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ মে ২০২৪, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫

ভারত

কলকাতার প্রতিমা শিল্পীদের পাড়ায় 

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৭
কলকাতার প্রতিমা শিল্পীদের পাড়ায়  কলকাতার কুমারটুলিতে মূর্তি বানাচ্ছেন এক কারিগর

কলকাতা: “জানেন যেদিন সারা শহরে আলো জ্বলে ওঠে, ঘরে ঘরে আনন্দের বার্তা, যখন শারদ উৎসবে বাড়িতে দেবী দুর্গার আগমনে আকাশে বাতাসে বাজে আগমনীর সুর তখন বড় ফাঁকা লাগে। হু হু করে ওঠে বুকটা। দীর্ঘ ছয় মাস ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা হিমালয় কন্যা উমা ঘর ফাঁকা করে বিদায় নেয় কুমারটুলি থেকে”।

স্টুডিওর বাইরে একটা মাদুরের উপর বসে অবচেতন মনে বলছিলেন, কলকাতার কুমারটুলির এক অশীতিপর মৃৎশিল্পী।

বিশেষ প্রতিবেদনের পরিকল্পনা করে রওনা দিয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গের সবথেকে বড় মৃৎ শিল্পীদের পাড়ায়।

কলকাতার কুমারটুলি। সেখানে গিয়েই শারদ উৎসবের একদম অন্য একটি দিক দেখতে পেলাম।

দুর্গাপূজা আসতে আর এক মাসের মত বাকি। সেই উপলক্ষে শহরে সেজে উঠছে ধীরে ধীরে। কলকাতার আকাশের মুখ ভার। কখনো মেঘবৃষ্টি আবার কখনো দেখা যাচ্ছে শিমুল তুলার মত মেঘ। আর সেই মেঘ পিয়নের ঝোলার ভিতর থেকেই খবর আসছে শারদ উৎসব হাজির বাঙালির দোরগোঁড়ায়।

যারা মফঃস্বল কিংবা গ্রামে থাকেন তারা এতদিনে মাঠে কাশফুলের ঢেউ দেখে নিয়েছেন বোধহয়। আর যারা শহরে থাকেন তারা শরতের হাওয়ায় কাশফুলের ঢেউ না দেখতে পেলেও একটু লক্ষ করলেই প্রকৃতির রূপে উৎসবের চেহারা দেখতে পাচ্ছেন।

শারদ উৎসবের মূল বিষয় যে দুর্গা প্রতিমা তার বেশ বড় একটি অংশ তৈরি হয় উত্তর কলকাতার কুমারটুলিতে। বৈশাখ মাস থেকেই কাঠের পাটাতনের উপর বাঁশের কাঠামো বানানো হয়। তার পর খড় দিয়ে বেঁধে তাকে প্রতিমার আদল দেওয়া হয়।  তার উপর পড়ে মাটির প্রলেপ।

বৈশাখে মূর্তি তৈরি শুরু করেন পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরা। বাংলাদেশ থেকে স্বাধীনতার আগে বা পড়ে কলকাতায় এসেছেন এমন পরিবারের শিল্পীরা কাজ শুরু করেন ফাল্গুন মাসেই। এটাই চিরাচরিত প্রথা।

কুমারটুলির প্রায় প্রতিটি গলির মধ্যেই একটি –দুটি করে ‘স্টুডিও’। স্টুডিও বলতে যে ছবিটা চট করে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে ,তার সঙ্গে মেলালে ভুল হবে। সরু গলি তার মধ্যে টিন অথবা প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে নির্মাণ করা হয় একের পর এক মূর্তি। সামনে রাখা কাদার তাল। সেই কাদার তাল দিয়েই তৈরি হয় দুর্গা প্রতিমা। রোদে শুকিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে তাকে প্রায় সম্পূর্ণ করার দিকে নিয়ে যান শিল্পীরা।

বৃষ্টির জন্য কিছুটা সমস্যা হলেও, কাজ থেমে নেই। দরকার মত গ্যাস বার্নার জ্বালিয়ে মূর্তি শুকিয়ে নিচ্ছেন কুমোরটুলির শিল্পীরা।  

বাজার কেমন? প্রশ্ন করতেই বেশ কিছুটা ঝাঁঝের সঙ্গেই উত্তর দিলেন এক তরুণ মৃৎশিল্পী। তার বক্তব্য, পূজার সব অংশে প্রচুর খরচ করলেও মূর্তি কেনার সময় পূজা কমিটিগুলির কর্তারা ব্যাপক দরদাম করেন।  

প্রতিমার গায়ে মাটি লেপতে লেপতে অপর এক শিল্পী জানালেন, পশ্চিমবঙ্গের নারদা সারদা কেলেঙ্কারির ছায়া পড়েছে শারদ উৎসবের বাজেটে। বিগত তিন চার বছরে চিট ফান্ডের বাড়বাড়ন্তে পূজার জৌলুস অনেকখানি বেড়েছিলো। এই চিটফান্ডগুলো বর্তমান বাজারে নেই, তাই বিজ্ঞাপনের পালে ভাটা। আর সেই ভাটার টান পড়েছে কুমারটুলির অর্থনীতিতেও।

যে অসুর দলনী দেবী দুর্গার বিরাট মাপের প্রতিমা গুলি আমরা দেখতে পাই, কি ভাবে রূপ পায় সেগুলো। মূর্তি গড়ার ধাপ গুলো নিয়ে কথা হচ্ছিলো, প্রবীণ শিল্পী তপন পালের সঙ্গে। তিনি জানালেন প্রথমে নিচের কাঠের তক্তা দিয়ে কাজ সরু হয়। তারপরের অংশটিকে বলে ‘খিলোন’ করা। এই অংশে বাঁশ আর খড় দিয়ে কাঠামোর রূপ দেওয়া হয়। তারপর তার উপর দেওয়া হয় মাটি প্রলেপ। নিজের বানানো প্রতিমার সামনে কুমারটুলির এক মৃৎশিল্পী

এই মাটির সঙ্গে মেশানো থাকে ধানের তুষ।  তুষ মেশান মাটির প্রলেপকে কুমারটুলির ভাষায় বলে ‘একমেটে’। ‘একমেটে’ এর পর গঙ্গার পলি মাটি দিয়ে হয় পরের প্রলেপ। এই প্রলেপকে বলে ‘দোমেটে”।

‘দোমেটে’ করার আগেই বানিয়ে নেওয়া হয় প্রতিমার মুখ। একে একে আলাদা করে বানানো হয় প্রতিমার হাতের ও পায়ের পাতা। সেগুলো লাগিয়ে দেওয়া হয় মূর্তির সঙ্গে। তারপর সুতির কাপড় কাদাতে ভিজিয়ে প্রতিমার ফাটল গুলো সাড়িয়ে ফেলা হয়। এরপর তার উপর খড়ি দিয়ে সাদা রং করা হয়। সবশেষে করা হয় প্রতিমার রং। আর তার পরেই আঁকা হয় মায়ের চোখ। তবে যত সহজে লিখে ফেলা গেল কাজটি মোটেই তত সহজ নয়।  

এক স্টুডিও-এর সামনের ছোট্ট উঠানে বসে কথা বলতে বলতে আমাদের পশে এসে দাঁড়িয়েছেন বছর ৪০-এর এক সুঠাম চেহারার পুরুষ। নিখুঁত করে দাঁড়ি কামানো মুখে একখানা পাটের মোটা গোঁফ বসিয়ে দিলে সহজেই মাটির অসুরদের চেহারার সাথে পাল্লা দিতে পারেন।

ইনি কুমারটুলির কুলিদের সর্দার। যাদের কুমারটুলিতে পুজা শুরুর ঠিক আগে হাজির থাকার অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন কি ভাবে রাস্তার একধারে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে আট চাকা বা দশ চাকার গাড়ি।

কুমারটুলির শিল্পীদের সমিতির অফিস থেকে এক নাগাড়ে ঘোষণা চলতে থাকে অমুক পূজা সমিতি তার লরি নিয়ে এগিয়ে আসুন, তমুক কুলি সর্দার এত নম্বর গাড়িতে প্রতিমা তোলার জন্য চলে আসুন ইত্যাদি। পুলিশ, পূজা কমিটির কর্মকর্তার ভিড়, কুলিদের চিৎকার, গাড়ির চালকদের হাঁক ডাকে এক বিচিত্র অবস্থা হয় কুমারটুলিতে। তবে পঞ্চমীর পর ফাঁকা হয়ে যায় এই পাড়ার সব কটি গলি।  

সেই গলি ধরেই কিছুটা এগুলাম। জমা মাটির তালের সামনে বসে পুতুল বানাচ্ছিলো একটি ছোট্ট মেয়ে। পাশে তার বাবা দ্রুত হাতে প্রতিমার গায়ে মাটির প্রলেপ দিচ্ছিলেন। তাকে প্রশ্ন করলাম, মন খারাপ লাগে না যখন ফাঁকা হয়ে যায় কুমারটুলি। একবারের জন্য মুখ তুলে তাকালেন। কাঁচাপাকা না কামানো দাড়িগোঁফওয়ালা মুখে খেলে গেল এক টুকরো নিরুত্তাপ সৌজন্যের হাসি। কাজ করতে করতেই বললেন, আগে লাগতো জানেন, খুব মন খারাপ লাগতো। তবে এখন আর লাগে না। এটাই তো আমাদের ব্যবসা। সরু গলি মাথায় প্লাস্টিকের ছাউনি, ভিতরে অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই যেন মিলিয়ে গেল সেই হাসিটুকুও।

কথায় কথায় উঠে এলো, পরের প্রজন্মের অনেকেই চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। আবার কেউ কেউ বাপ-পিতামহের ব্যবসা আঁকড়ে পড়ে থাকছেন। থিমের পূজায় যারা প্রতিমা বানান তারা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে এই কাজে আসেন। তারা শিল্পীর মর্যাদা পান, কিন্তু কুমারটুলির প্রতিমার কারিগররা সেই মর্যাদা পান না।

“কে খেয়াল রাখে মূর্তির নীচে ছোট্ট কাগজে লেখা এই শিল্পীদের নামগুলিতে। ভক্তদের ফুল মালার চাপে সেগুলি আর দেখাই যায় না। “ এই আক্ষেপটা আছে অনেকেরই।  

সেই আক্ষেপ বুকে নিয়েই বছরের পর বছর ধরে প্রতিমা বানিয়ে চলেছেন ওনারা। সঙ্গে আছে বাড়োয়ারি পূজার উদ্যোক্তাদের দরাদরি, ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের বোঝা, মহাজনের ধার, সাজসজ্জার চড়া দাম, দালালদের উৎপাতসহ আরও নানা রকম সমস্যা।

আর আছে আধুনিকতার আগ্রাসন। তবে এই সমস্ত বাধার সঙ্গে লড়াই করেও কুমারটুলির শিল্পীরা ধরে রেখেছেন তাদের ঐতিহ্য তাদের শিল্পকে। আর এটাই এদের একমাত্র অহংকার।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৭  
আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।